Sunday, June 19, 2016

বিষয়ঃ সময়ের দলিল

Posted on by
 
প্রিয় পাঠক/ব্লগার,

আমাদের বন্ধু সমীর ভট্টাচার্য সম্পর্কে এর আগে একটি লেখা বাংলাব্লগে প্রকাশ করেছিলাম। ইদানিং তিনি ফেসবুকে নিয়মিত লিখছেন। বাংলাব্লগের তরফে ফেসবুকে পোস্ট করা তাঁর একটি অনবদ্য লেখা আমরা পুনরায় প্রকাশ করলাম। কেমন লাগলো জানাবেন, মতামত পোস্ট করুন এই আমাদের অনুরোধ। ধন্যবাদ!

–বাংলাব্লগ টিম


সময়ের দলিল-১

ফেসবুক / ১৩ জুন ২০১৬ রাত্রি ১.০১ মি।

 

সমীর ভট্টাচার্য

সমীর ভট্টাচার্য 

আমাদের তো ছিল দীর্ঘ যাত্রা পথ। দীর্ঘ আলোচনা। করতলে ধৃত আমলকী ছিল ব্রহ্মাণ্ড। আমাদের সঙ্গে ছিল রাশি রাশি বই। কোটেশন । সংবাদপত্রের পুস্তক পরিচিতি ও সমালোচনা, সমাজ বিপ্লবের যাবতীয় দলিল দস্তাবেজ। শহর নগর কারখানা গ্রামাঞ্চলের খুঁটিনাটি পর্যন্ত প্রলম্বিত। দাড়িতে হাত বুলিয়ে আমরা বলতে পারতাম গুয়াতেমালা থেকে দিয়েগো গার্সিয়া, গর্বাচেভের গার্লফ্রেন্ড থেকে হোচিমিন সরণী পর্যন্ত আমাদের যাতায়াত। রাতজেগে ইয়াংসো গদার বা ফার্নান্দো সোলানাস, ঋত্বিক কুমার ঘটক থেকে রামকিঙ্কর বেইজ, চে গেভারা থেকে শ্রীকাকুলাম সবই গলাধঃকরণ করেছি। খুবই নিশ্চিন্তে ছিলাম মহেন্দ্র দত্তের ছাতার মত মার্কস ও কোকাকোলার ছায়ায় (অবশ্য পেপসিও কম যায় না ), বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘শঙ্খচিল ‘এর গানে গর্জনের মাঝখানে, ব্যারিটোন টানে দেবব্রত বিশ্বাসের ‘বিশ্বভরা প্রাণ’ এ। ছাত্র রাজনীতির দিন শুকিয়ে গেলে আমরা বুবুঝলাম, বেলা হল । অর্থাৎ আমরা চল্লিশ পেরিয়েছি । ততদিনে অনেকেই বিবাহিত । অনেকেই সাগরপাড়ি। অনেকেরই পক্ককেশ, মায় বিরল কেশ পর্যন্ত । বেদনার সন্তান হয়ে গেলাম আমরা। ঐ যে, যৌবন যায়, যৌবন বেদনা যে যায় না ….! অনেকেই কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসের সন্ধ্যার আড্ডা ছেড়ে সন্ধ্যার পানশালায়, অনেকেই দিশী,কেউ কেউ বিদেশী তরলের গ্লাসে ভিজিয়ে নিচ্ছি দস্তয়ভস্কি থেকে কাফকা বা গ্যাব্রিয়েল মার্কেজের নিঃসঙ্গতার অভিযাত্রা। হাতের পেজার রূপান্তরিত হলো সেল ফোনে। এল একুশ শতকের হাওয়া। সেই হাওয়ায় আমরা কৃত্তিবাস, হাংরি জেনারেশন, বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ,1970 দশকের এর গোলাপের পাপড়িগুলোকে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে দিলাম। ইন্টারনেট বা অন্তর্জাল যাত্রা আমাদের পথ সুগম করে তুললো আরও। বাজার খুলেছিল আগেই। গানে কবীর সুমন (সুমন চট্টোপাধ্যায় ) ‘গানওয়ালা ‘ অভিধায় বাজারের রঙ্গ-কে আলিবাবার চিচিংফাঁক মন্ত্রে খুল্লাম খুল্লা করে ছাড়লেন। ‘মহীনের ঘোড়া ‘র গৌতম চট্টোপাধ্যায় নিওলিথ স্তব্ধতায় ধীরে ধীরে ঢাকছেন। চিত্রকলায় ও ভাস্কর্যে রামকিঙ্কর বেইজের মহাপ্রস্থানের পরে আমরা তবু টেনে নিয়েছিলাম নিখিল বিশ্বাস থেকে মীরা মুখার্জী, প্রকাশ কর্মকার, আরও অনেকানেক শিল্পীকেই । আমরা, মানে এই আমাদেরই শিল্পকলার লোকজন। ছবি থেকে গান, বাগান থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে জমি সবকিছুই বিক্রয়যোগ্য হয়ে উঠলো। প্রোমোটিং এর কল্যাণে রাশি রাশি হাউসিং কমপ্লেক্স ও বিগবাজার শপিং মলের উত্থান। এ ছিল হিমশৈলের চূড়ার মতো। মাথাটা দেখা যাচ্ছিল। বিস্ফোরণের মতো নেমে এলো সামাজিক বড়ো আন্দোলনের নেতারা । নিজের বাগানে ফুল ফোটানোর থেকে হর্টিকালচারে সানফ্লাওয়ার দেখতে পছন্দের লোক বেড়ে গেলো। ফুলের পুরোনো দোকানগুলিতে শিক কাবাব ঝুললে আমরা পছন্দ করলাম বেশি। ইন্টারনেট থেকে শুরু করে মোবাইল অ্যাপে ভেসে উঠল জলপরীদের সর্বাঙ্গ। সমস্ত প্রতিবাদ ভেসে গেলো চুম্বনে চুম্বনে।
(এ লেখাটি আমারই। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় না, ফেসবুকে শেয়ার করি, সেরকম একটা লেখার অংশ। তবে লোকজনকে বোর করবো না। এইটুকুই দিলাম।)

সময়ের দলিল-২


ফেসবুক / ১৪ জুন ২০১৬ রাত্রি ৯.২৬ মি।



সমীর ভট্টাচার্য

না । আমরা আর পাড়ার জঞ্জাল সাফাই অভিযানে যুক্ত হলাম না। আশপাশের যাবতীয় ধূর্তামী ও হিংস্রতাকে ফেসবুকে ঢুকিয়ে দিলাম। বুক চিতিয়ে দাঁড়ালাম না, কেননা আমাদের বুক নেই। ‘ধর্ষণ ‘এর যাবতীয় তথ্য টেলিভিশন বা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনে সংবাদপত্রেই প্রতিবাদী চিঠি লিখতে শিখলাম। ধর্ষণ কি ও কেন এবং কারা দায়ী ইত্যাদি নিয়ে চায়ের দোকান সরগরম করে তুললাম। যেহেতু একদিন ঘর থেকে শুরু করে বিশ্বের সব জায়গাকেই মুক্তাঞ্চল ভাবতে শিখেছিলাম, তাই, এমনকি, রাতবিরেতের পাড়ার নৈশ পাহারার মানুষগুলিও নিরাপত্তার অভাবে টিভি চালিয়ে যাবতীয় দুষ্কর্মের সাক্ষী হতে চাইলাম। কোন জেলায় নদীপাড় ভাঙন রোধ, বস্তি উচ্ছেদ, প্রকৃতির ঝড়ের শিকার, বন্যায় আক্রান্ত দুর্গতদের কাছে যাওয়া, পাঠ্য তালিকায় বিপুল অসংগতি, প্রান্তিক মানুষদের সরকারি সাহায্যের মাঝখানে গজিয়ে ওঠা কিছু মানুষের অবিচার, গণহারে শিশুমৃত্যু, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থায় চূড়ান্ত অসঙ্গতি, এমনকি সমালোচনায় সরব মানুষদেরও ভোট নির্ভর প্রতিবাদ সব কিছুকেই আমরা মান্যতা দিলাম। আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসে নানা আর্থিক অনাচার। কিন্তু যে আমরা মার্কস থেকে গান্ধী, যে আমরা চে গেভারা থেকে মিশেল ফুকো, যে আমরা রবীন্দ্রনাথ থেকে নবারুণ, রামকিঙ্কর থেকে মীরা মুখোপাধ্যায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস থেকে আজকের রাস্তায়,সেই আমরাই, কি আজ কোন গোপনাভিসারে লিপ্ত ? সবটাই কি ‘কাফকা কামু সার্ত্র / উল্টে গেল পাত্র? "

এই বিপুল জলতরঙ্গ রুধিবে কে। উদ্ধৃতি ,পাল্টা উদ্ধৃতি, পাহাড় প্রমাণ সংখ্যাতত্ত্ব, তথ্য ও বিপুল জ্ঞান ভান্ডার মাথায় নিয়ে “অপরের ম্লান মুখ দেখা ছাড়া প্রিয় সাধ” নেই আমাদের? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অতি বিখ্যাত লাইন “নাদের আলি, আমি আর কত বড়ো হবো “কাঁপা গলায় আবৃত্তি করে বেড়াবো ?
বড় বাঁধ, বড় বিপ্লব, বড় গাড়ি,সব সঅঅঅঅব আমাদের হতেই হবে? ছোটরা সবাই সচিন, সৌরভ, বাইচুং ভুটিয়া হয়ে উঠবে? এর পেছনে যে মুদ্রারাক্ষসের বিরাট ভূমিকা আছে, কে অস্বীকার করবে ? এই যে আমি লিখছি, আমিও কি এই বৃত্তের বাইরে? হয়তো কেন, নিশ্চয়ই নয়। তবু আজকে মনে হয় আমাদের জীবন থেকে চলে গিয়ে কি প্রকান্ড এক জ্বালামুখের দিকে চলেছি। সেই জ্বালামুখ কি শেষে আমাদেরকেই গিলে নেবে?

“কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে, হায় “। লিখলাম বটে ! সত্যিই কেউই বেদনা জাগাতে ভালোবাসে না । কোথায় কারা কিভাবে দিনাতিপাত করে, আমরা সাব-অলটার্ন আর মারজিনালিটি- র থিয়োরি গুলে খাওয়া লোকজন দুটোর আর তফাৎ করতে পারি না আজকাল । যেমন আমি চিন্তায় ‘এলিট ‘, বার্ডস আই ভিউ থেকে সংসার দেখা লোক, এদিকে টাকা পয়সার দিক, র্টের দিক থেকে মার্জিনাল। আমাদের অনেকেরই হয়তো বা সেই অবস্থা! শুধু Z!নতি পারো না। ভলতেয়ারের কাঁদিদ-এ শেষ লাইনটা ছিল অনেকটা এরকম ,আসল কথা হল নিজের জমি নিজে চাষ করা। ফয়েরবাখ-ও নাকি শেষ জীবনে গ্রামে গিয়ে নিজের জমি নিজে চাষ করতেন। আর শেষ কথাটা তো আমাদের গীতিকার কবি সাধক রামপ্রসাদ সেনই বলে গিয়েছিলেন, “এমন মানব জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা “। সোনা তারপর বাংলায় কিছু ফলেও ছিল। তা দিয়ে আমরা গয়না বানিয়ে ফেলেছি। সেই গয়নার ঝলকানিতেই আমাদের আপাতত চিৎকার, শীৎকার চেঁচামেচি ইত্যাদি প্রভৃতি। “তবু কোথাও মায়া রহিয়া গেল।”

(এই লেখাটি আমার আগের লেখাটার শেষাংশ। ভেবেছিলাম এইসব হাবিজাবি লেখা পোস্ট করবো না। কেউই পড়ে না, আমিও পড়িনা। তারপর মানুষজন বোকা নয়। সবাই সব কিছু জানে বোঝে । ফালতু তাঁদের সময় নষ্ট। কিন্তু, আমারও তো কিছু একটা করা চাই। এইসব হাবিজাবি পোস্ট করলাম সেই কারণেই। উপদেশ : কেউ এইসব লেখা পড়বেন না প্লীজ। জ্ঞান নেই আমার । অজ্ঞানতা আমার পুঁজি। জ্ঞানী মানুষজন ক্ষমা করবেন।)

 

Posted in আলোচনা, প্রবন্ধ, রাজনীতি, শিল্প, সংবাদ, সমাজ, সাহিত্য | Tagged , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , | মন্তব্য দিন | সম্পাদনা

No comments :

Post a Comment