কে দেবে আলো, কে দেবে
আশা, কে যোগাবে ভরসা !..?
বছর কয়েক আগের কথা। সেদিন ছিল শুক্রবার। মধ্যরাত্রি। আকাশবাণীর ‘অনেক
কথা বলার ছিলো’ অনুষ্ঠান শুনছি। যেমন গত দশ বছরের উপর প্রায় অনুষ্ঠানের
জন্মলগ্ন থেকেই এই অনুষ্ঠান শুনে আসছি। কত মানুষের কত সমস্যার কথা মনের
কথা। ফোন, এসএমএস, চিঠি, ই-মেল- এগুলোর মাধ্যমে অনুষ্ঠান-সঞ্চালকের কাছে
পৌঁছে যায় একের পর এক সমস্যার কথা। সঞ্চালক চেষ্টা করেন যথেষ্ট দক্ষতার
সঙ্গে প্রতিটি সমস্যার সমাধান বা পরামর্শ দেওয়ার। অনেক সময় অনেক অভিজ্ঞ
মানুষরাও এগিয়ে আসেন সুপরামর্শ দেওয়ার জন্য। হাত বাড়িয়ে দেন সাহায্যের
জন্য। শ্রোতারাও সারা সপ্তাহ ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন এই অনুষ্ঠানটির
জন্য। এ যেন স্টেথোস্কোপের মতন সমাজের গভীরতম তলদেশ থেকে তুলে আনে হৃদয়ের
স্পন্দন! কত দু:খ কত বেদনা কত যন্ত্রণা আবার সাফল্যের হার্ট বিট্ মেশানো
সাংকেতিক আবহ।
এরকমই একটি চিঠি পাঠ করছিলেন অনুষ্ঠান-সঞ্চালক। চিঠিটির প্রেরক একজন
ছাত্র। নাম মধুসূদন গোঁড়া। অভিভাবকের নাম জয়দেব গোঁড়া। বাড়ী
হাওড়া-উলুবেড়িয়ার বীরশিবপুর অঞ্চলে। চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি মধুসূদন
চাষী পরিবারের সন্তান। মধুসূদনের পরিবার অসম্ভব দরিদ্র। ক্ষেত মজুরী করে
কোনোক্রমে দিন চলে তাঁদের। পড়াশোনার পাশাপাশি চাষের কাজে যুক্ত হতে হয়
মধুসূদনকে। মধুসূদনের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট খুব ভালো। কয়েকটি
টিউশান করে মধুসূদন যে টাকা পেতো তার অনেকটাই তাকে বাড়ীর সদস্যদের চাপে
সংসারে দিয়ে দিতে হতো। ফলে সামান্য যা কিছু থাকতো তা দিয়েই সে পড়াশোনার কাজ
চালাতো। এই অবস্থার মধ্য দিয়েই সে প্রথমবার জয়েন্ট এনট্রান্স পরীক্ষায়
সফল হয় এবং জেনারেল কোটায় ১১০০তম স্থান অধিকার করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে
ইলেকট্রনিক্স ইন্জিনিয়ারিং-এ প্রথমবর্ষে ভর্তি হয়। কিন্তু অর্থাভাবে তার
পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। মধুসূদন ফিরে আসে এবং স্থানীয় কলেজে ভর্তি হয়।
কিন্তু তাও সম্ভব হয় না অর্থাভাবে। এবারও পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় মধুসূদনের।
ইতিমধ্যে মধুসূদন একটি টিউশান বাড়ীর সহযোগিতায় দ্বিতীয়বার জয়েন্ট এনট্রান্স
পরীক্ষায় বসে এবং জেনারেল কোটায় ৭০০তম এবং এস সি কোটায় ৩৭তম স্থানাধীকারী
হয়ে ঐ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েই কমপিউটার সায়েন্স নিয়ে প্রথমবর্ষে ভর্তি হয়।
এখন প্রচন্ড অর্থাভাবে সে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে অক্ষম তাই মধুসূদন ঐ
চিঠির মাধ্যমে একটি আবেদন জানিয়েছে যে কেউ যদি বিনা অর্থে বা সামান্য টাকার
বিনিময়ে তাকে থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেন তাহলে তার পড়াশোনাটা সে
চালিয়ে যেতে পারবে।
এ পর্যন্ত শুনে আমরা শ্রোতারা স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। কি করা যায় কি করা
উচিত এসব ভাবছি। ইতিমধ্যে সঞ্চালক একটি গান চালিয়ে দিয়েছেন। গানটি শেষ হবার
সাথে সাথে সঞ্চালক আমাদের জানালেন যে গানটি চলাকালীন দু-জন শ্রোতা-বন্ধু
ফোনে যোগাযোগ করে মধুসূদনের ফোন নাম্বার চেয়েছেন, তাঁরা মধুসূদনের সঙ্গে
কথা বলতে চান। এর কিছুক্ষণ পরে একজন মহিলা শ্রোতা-বন্ধু ফোন করলেন এবং তিনি
কিছু বলছিলেন যা আমার রেডিওর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ভালো করে শুনতে পারি
নি। কিন্তু পরে সঞ্চালক আমাদের জানালেন যে ঐ শ্রোতা-বন্ধু মধুসূদনকে
আশ্বস্ত করেছেন এবং জানিয়েছেন যে মধুসূদন যেন চিন্তা না করে, দিদি ঠিক সময়ে
তার কাছে পৌঁছে যাবে। আমরা শ্রোতারা কিছুটা আশ্বস্ত হলাম এবং বুঝলাম যে
পৃথিবীটা এখনও শুকিয়ে যায় নি–প্রকৃত মানুষরা আজও আছেন! তবে তাঁরা সংখ্যায়
খুবই নগণ্য। আর তাঁদের সামর্থ্যই বা কতটুকু? এতো ধূ ধূ মরুভূমির বুকে
একফোঁটা বৃষ্টির মতন। তবুও যাহোক মধুসূদনরা আজও এইসব সংবেদনশীল মানুষদের
সহযোগিতা টুকু পেয়ে একটু একটু করে এগোতে পারছে এটা ভেবে খানিকটা স্বস্তি
পাই আমরা।
এইখানেই হয়ত থেমে যাওয়া যেত। এরকম অনেক ঘটনার আর একটি ঘটনার সংযোজন বলে
এড়িয়ে যাওয়া যেত। কেননা এই ধরণের ঘটনার কথা আমরা অহরহ শুনতে পাই,আর শুনতে
শুনতে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেছি। কেমন যেন গা সহা হয়ে গেছে। আমরা যেন এই কথাটা
আর ভাবতে পারি না যে এসব ঘটনার কথা আর কোনওদিন শুনতে হবে না এরকম এক উন্নত
সমাজে আমাদের উত্তরণ ঘটে গেছে! কিন্তু কেন? কেন এরকম হয়? এমনটা তো হবার
কথা ছিল না! যারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে বহু আত্মবলিদান, বহু রক্তপাত, বহু
সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ নামক এই ভূখণ্ডটাকে বিদেশী দখলদারদের হাত
থেকে মুক্ত করেছিলেন, সমাজটাকে সংস্কার করছিলেন, তাঁদের একটা অমলিন স্বপ্ন
ছিল যে স্বাধীন দেশের ভোটাধিকার প্রাপ্ত নাগরিকরা খুব সচ্ছল জীবনযাত্রা না
হোক অন্ততঃ মোটা ভাতকাপড়, কর্ম, আশ্রয়, স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত হবেন না আর
সবথেকে জরুরী যে বিষয়–শিক্ষা তার অন্ততঃ কোনও অভাব হবে না, থাকবে না কোনও
প্রতিবন্ধকতা, তা সেই মানুষটা যে শ্রেণীরই হোন না কেন। কিন্তু কোথায় গেল
তাঁদের সেই স্বপ্ন? সে কি শুধু ইতিহাসের কল্পকথা? নাকি তামাদি হয়ে যাওয়া
একটা শপথ! যারাই একটু সংবেদনশীল তাঁদের মনের আনাচে কানাচে এই প্রশ্নটাই
ঘুরেফিরে আসে! কোনও এক স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে জনপ্রিয় একটি বাংলা
দৈনিকের ক্রোড়পত্রে একজন বরিষ্ঠ কবির খেদোক্তি আজও স্মরণে আসে। আমরা পড়ে
ক্ষণিক স্তব্ধ হই বটে,তারপর যে কে সেই! আমরা উদসীন হয়ে যাই। আমরা ব্যস্ত হই
যার যার নিজের কাজ নিয়ে, আয় রোজগার নিয়ে, সংসার প্রতিপালন নিয়ে,সন্তানের
লেখাপড়া নিয়ে। কার আর অত সময় থাকে পরের কথা ভাববার? পরার্থপরতা সমাজ জীবন
থেকে উধাও হচ্ছে। স্বার্থপরতাই প্রাধান্য পাচ্ছে। হয়ত আধুনিক সমাজের লক্ষণ
সেটাই। কিন্তু প্রশ্ন জাগে মনে, এ কোন আধুনিকতা? আধুনিকতা মানেই কি শুধু
আত্মস্বার্থ চরিতার্থতা? আমাদের সমাজ আধুনিক নাকি উত্তর আধুনিক না প্রাক
আধুনিক –এই গূঢ় প্রশ্নের মীমাংসা করার জন্য কূট তর্ক-বিতর্কের ইচ্ছা এখানে
আমাদের নেই। সে দায়িত্বটা অন্যদের। প্রশ্নটা হল যে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার
প্রসারণের ফলে যে আলোকদীপ্তি একটা মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণায় নিমজ্জিত সমাজের
উপর আলো ফেলল, সেই আলোকদীপ্তি কোথায় গেল? কোথায় গেল সেই রাজনৈতিক সচেতনতা,
যে সচেতনতা মানব মুক্তির কথা বলত? রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দলগুলির গত ৬০ বছর
যাবত ভোটের সময় লম্বা লম্বা নির্বাচনী ইস্তাহারের ফিরিস্তি, অগুনতি
প্রতিশ্রুতি, শপথ–কোনও কিছুই তো বদলাতে পারল না এই বৃহত্তর মাপের অভাব
অভিযোগের! আমাদের এই কথাটা বলার উদ্দেশ্য নয় যে রাষ্ট্রর কোনও সদিচ্ছা নেই
বা এই সংকট থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায় তার দিশা খুঁজে বার করার কোনও
সদর্থক প্রচেষ্টা নেই। রাষ্ট্রীয় তহবিল বা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে
যে আর্থিক অনুদান পাওয়া যায় তার কতটুকু পৌঁছায় ঐসব ক্ষেত্রে? আমাদের
প্রত্যহ অভিজ্ঞতাটা অন্যরকম এ ব্যাপারে। কথায় আছে, গ্রামে ১ টাকা পাঠালে
মাত্র ২৫ পয়সা যায় বাকী ৭৫ পয়সা কারুর পকেটে ঢোকে। অর্থাৎ দুর্নীতি যা
ভারতবর্ষ নামক দেশটাকে ছিবড়ে করে দিচ্ছে। ঘুষ আর টাকা চুরির (কাট মানি)
ঠ্যালায় আম জনতার জীবন বিপর্যস্ত! সুতরাং উন্নয়ন অসম। কসমোপলিটান শহর গুলোর
বাড়বাড়ন্ত, ফ্লাই ওভার, শপিংমল হাই-রাইজের ব্যাপক বিস্তার অথচ
প্রান্তবর্তী সীমানায় যারা রয়েছেন তাঁরা সর্বাধিক বঞ্চিত, তাঁদের জীবনের
কোনও পরিবর্তন নেই–পাণীয় জল, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল বা
স্বাস্থ্যকেন্দ্র, শিক্ষাকেন্দ্র সুদ্ধু সামগ্রিক প্রয়োজনীয় ও যথাযথ
পরিকাঠামোর ভয়ঙ্কর অভাব। বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। শহর ও গ্রামের মধ্যে ফারাক
বেড়েই চলেছে। “দেহের সমস্ত রক্ত মুখে এসে জমছে।”
এই রক্ত জমাটবাঁধাটা কি ভাল লক্ষণ? সার্বিক উন্নয়নের কথা যারা ভাবেন
তাঁদের কাছে এই লক্ষণ মোটেই সদর্থক নয়। এতে তো শুধুমাত্র দেশ বা সমাজের মূল
কেন্দ্রগুলিতে বসবাসকারী মানুষজন বা আর একটু মননিবেশ করে অনুসন্ধান করলে
দেখা যাবে যে মূলতঃ শহরবাসীরাই এই “দেহের সমস্ত রক্ত মুখে এসে জমছে ..”-র
সর্বাধিক সুবিধা ভোগী। সেখানে ভোগের নানা আয়োজন। আমোদে ফুর্তিতে উড়ে যাচ্ছে
লাখ লাখ টাকা; শুধুমাত্র শারদ উৎসবেই কোটি কোটি টাকার বন্যা বয়ে চলে যখন
সত্যিকারের বন্যায় গ্রামবাংলা ভাসে ফি বছর!
শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য-থিয়েটার-সিনেমায় বয়ে চলা প্রগতিশীলতার বন্যায়
ভাসমান আমুদে বাঙালী, হয় কথায় নয় কথায় মিছিল মিটিং-এ জেরবার, সোচ্চার
“কল্লোলিনী” কলকাতার “তিলোত্তমা” হয়ে ওঠার কাব্যিক তকমা (যা হয়তো মহতী কবির
জীবন সম্পৃক্ত ভাবনায় অন্যরকম ছিল!) বা গা চিড়বিড় করানো “ডেড সিটি” উপাধি
প্রাপ্তির আড়ালে কেমন করে যেন হারিয়ে যায় প্রান্তিক মানুষদের দুর্গতির কথা!
একজন মেধাবী ছাত্র জে.ই-র মতন কঠিন পরীক্ষায় চমকপ্রদ সাফল্য দেখিয়ে শহরের
সর্বোচ্চ মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েও ফিরে যায় শুধুমাত্র
টাকার অভাবে! কারণ সে মধ্যসত্বভোগী নয়, প্রিভিলেজড ক্লাসের প্রিভিলেজের
ল্যাজটা যে তার হাতের মুঠোয় নেই! কারণ সে যে নিম্নবর্গীয়! ভাবতে অবাক লাগে
কবে আসবে আমাদের লজ্জাবোধ!!? আমরা ক্রিকেট-কার্গিলে ভীষণরকম জাতীয়তাবাদী;
চেতনায় পোস্টমর্ডান হলেও একটু আধটু রেসিস্ট, না হলে আর সিন্ধুপারের হিন্দু
হলাম কি করতে? সোনার চাঁদ সোনার টুকরো বলে তো ওদেরকে খানিকটা ঠেকিয়ে রাখা
গেছে!! পোস্ট মডার্নের পোস্ট বেয়ে ছেয়ে যে তরতর করে উপরে উঠতে হবে, না হলে
আর কি হল!!? সবই যে বৃথা! নাঃ!.. নেই! আমাদের কোনও লজ্জাবোধ নেই!!
উন্নয়ন শব্দটা এখন একটা খুব জনপ্রিয় মুখরোচক, আমরা চাই বা না চাই এটা
ঘাড়ের উপর চলে আসবেই। শব্দটার মধ্যে অনেককিছু জড়িয়ে যায়। কৃষকের জমির দখল
নেওয়া থেকে মধ্যবিত্তের ঝাঁ চকচকে বিদেশী স্টাইলের নাগরিক জীবন যাপনের
স্বপ্ন, শিল্পপতিদের কলকারখানা থেকে নগরায়ন, উন্নত পরিকাঠামো, যোগাযোগ
ব্যবস্থা–এ সব ঢুকে পড়েছে এই শব্দটার মধ্যে। আজকের দিনের স্বপ্নের নিরিখে
“উন্নয়ন” নামক এই ভয়ানক মহার্ঘ শব্দটার মাহাত্ম্য অনেক। শ্রেণীগত বিভেদের
আড়ালে এর এক এক রকম অর্থ। যা এক শ্রেণীর মানুষের পক্ষে ভালো তো আর এক
শ্রেণীর মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর। তার উপর চাওয়া পাওয়া গুলোর মধ্যে নেই কোনও
সামঞ্জস্য। অর্থাৎ সকল শ্রেণীর মানুষের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে এমন কোনও
পরিকল্পনা কখনোই গড়ে ওঠে নি। না হলে কি আমরা বলতে পারতাম যে শিল্পায়নের
ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠা উপনগরীতে চাকর বাকর কিম্বা ধোপা নাপিতের কাজ করবে
পিতৃপুরুষের অর্জিত-জমি হারানো চাষী পরিবার, উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের
অভাবে যাঁদের কোনোভাবেই স্থান হওয়া সম্ভব নয় ঐ ইন্ডাস্ট্রিতে। আমরা
চেয়েছিলাম ঐতিহ্যগত পেশা থেকে তাঁদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে! অথচ পাঁচহাজার
বছর ধরে পরিচালিত কৃষিব্যবস্থা থেকে বংশানুক্রমিক ভাবে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও
তাঁদের কৃষি-জ্ঞান থাকবে উপেক্ষিত, না হবে তা নিয়ে কোনও আলোচনা, না হবে
কোনও গবেষণা, না গড়ে উঠবে কোনও পূর্ণাঙ্গ তথ্যভান্ডার যা ঘটাতে পারত পড়ন্ত
কৃষি-শিল্পের নতুন উজ্জীবন। তা না করে আমরা শিল্পায়ন শিল্পায়ন করে উদ্বাহু
নেত্য শুরু করলাম আমাদের সৌখিন স্বপ্ন চার চাকার একটি যান্ত্রিক গুবরে
পোকা বা আরও অনেক কিছুর জন্য! তার পরের সব কুৎসিত ঘটনাবলী, যা
ফ্যাসিস্টদেরকেও নিঃসন্দেহে অনুপ্রাণিত করবে–সে সব আজ ইতিহাস। নিতান্ত
হাটুরে মানুষ থেকে সুশীল সমাজ ঘুরে দাঁড়িয়ে যখন পাল্টা প্রতিবাদে ফেটে
পড়লেন তখন প্রগতিবাদীতার মিথ্যে ধ্বজাধারী-গণশত্রুদের উদ্ধত ল্যাজ নেতিয়ে
দু’পায়ের ফাঁকে ঢুকে গেল। সে সময় আমরা নির্ভীক সাংবাদিকতা করেছি, ওবি ভ্যান
নিয়ে ইতিহাসের দলিল তৈরী করেছি, শিল্পায়ন নিয়ে প্রচুর কূটকচালী করেছি!
কিন্তু যেটা হারিয়েছি সেটা হল বিশ্বাস। দীর্ঘ বঞ্চনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের
বিশ্বাস যা হয়তো কক্ষনও আর ফিরে পাওয়া যাবে না! এ সবই প্রতিবাদী মানুষ ও
পরিবেশবিদদের দেওয়া তথ্য যে তথ্য বলছে ভারতে উন্নয়ন-উদ্বাস্তুর সংখ্যা
প্রায় আধকোটি যারা তথাকথিত উন্নয়নের বলি–উৎখাত হয়েছেন নিজের ভিটেমাটি থেকে।
কোথায় যে তাঁরা হারিয়ে গেছেন কেউ জানে না! এই বৈষম্য তৈরী করেছে বিভেদের
বিশাল প্রাচীর। বিক্ষুব্ধ প্রান্তিক মানুষ গুমরে গুমরে শেষ হয়ে গেছেন নয় তো
এই দেশটাকে নিজের দেশ বলে আর ভাবতে পারছেন না। খুবই ভয়ংকর একটা ভাবনা।
ভাবলে শিউরে উঠতে হয় যে এর ভবিষ্যৎ কোথায়! জোর জবরদস্তি করে কি কোনও
ন্যাশানাল আইডেন্টিটি গড়ে তোলা যায়? বোধহয় যায় না। সকলের ভাল হবে এমন
পরিকল্পনা কোথায়? এর উপর সমাজের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত
শ্রেণীর মানুষদের বিরাট এক অংশের ব্যাপক, মাত্রাহীন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে
পড়া!–যাঁদের কোনও চেদবেদ নেই, তাঁরা কি করছেন কেন করছেন সেটা নিয়েও নেই
কোনও অনুশোচনা। বরঞ্চ পরোক্ষভাবে এর প্রতি ভেতরে ভেতরে একটা প্রচ্ছন্ন
সমর্থন আছে তাঁদের! সবটাই ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠিগত স্বার্থ, ভাবনার ফসল।
দেশের প্রতিটি মানুষের সাথে যে গভীর সংযোগ-সংলাপ থাকা দরকার সে কথা তো
নতুন কোনও কথা নয়– আধুনিকতার প্রবক্তা, আমাদের বরণীয় মনীষীরা তা বারে বারে
বলেও গিয়েছিলেন আর তার জন্যই তো তাঁরা শিক্ষার উপর এতো জোর দিয়েছিলেন;
নিজেরাও সচেষ্ট ছিলেন কি ভাবে শিক্ষার আবহ গড়ে তোলা যায়, প্রসারণ ঘটানো যায়
সমাজের সর্বস্তরে, হোক না সে পরাধীন দেশ, তবুও! এটা ভাবতে খুবই অবাক লাগে
যে ঐ রকম একটা সময়ে কি ভাবে বিজ্ঞান চর্চা, গবেষণা, শিক্ষাদীক্ষায় প্রাবল্য
এসেছিল তা আজও এই স্বাধীন দেশে বসে আমরা ভাবতে পারি না! অথচ আজ তা
বুদবুদের মতো মিলিয়ে গেছে কোথায় যেন! আমরা হারিয়েছি সেই গৌরবোজ্জ্বল
দিনগুলো! তখন স্কুলকলেজ স্থাপন করা হত সমাজের সার্বিক মঙ্গলের জন্য আর এখন
হয় ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। আর সেখানে ভিড় করতে পারেন সমাজের অর্থবান মানুষরা।
যাঁদের সেই আর্থিক ক্ষমতা নেই, অগুনতি হতদরিদ্র নিম্নবর্গীয় মানুষ, তাঁরা
ব্রাত্য সেখানে। সরকারী অনুদানে চলা স্কুলকলেজ আর কটা যে বিপুল সংখ্যক
মানুষের চাহিদা মেটান যায়? পড়াশোনার মানও যে সব জায়গায় সমান তা নয়। অভাব
অভিযোগ বিস্তর। গোদের উপর বিষফোঁড়া সস্তা দলীয় রাজনীতির মাতব্বরি, সূক্ষ্ম
রেসিসিজম বা ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক মনোভাব সব মিলিয়ে শিক্ষার সার্বজনীন
প্রয়োগ দূরঅস্ত! এভাবেই শিক্ষার আলোক-স্পর্শ অধরা থেকে যায় রামা কৈবর্ত,
হাশেম শেখ, রামু বড়ালদের জীবনে।
এখানে একটা সত্যি ঘটনার কথা জানিয়ে রাখি। না জানালে অপরাধ হবে। বেশ
কয়েকবছর আগে, ৯০-র দশকের শেষদিকে আমরা কয়েকজন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে
শংকরপুর বেড়াতে গিয়েছিলাম। বিকালবেলা ফিসারিজ ডিপার্টমেন্টের অধীনে যে
বিশাল সমুদ্র সৈকত সেখানে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছি, সমুদ্রের বিশালত্ব,
সৌন্দর্য ইত্যাদি উপভোগ করছি। ছোটরা বীচে বালি নিয়ে খেলা করছে। এমন সময়
অনেকদূর থেকে, কালো কালো বিন্দুর মত লাগছে, একদল জেলে মাছ ধরার জাল ও
অন্যান্য সাজ সরঞ্জাম নিয়ে হেঁটে আসছে। সঙ্গের মেয়েরা দেখতে পেয়ে ঠিক করলো
ওদের কাছ থেকে মাছ কিনবে। কিছুক্ষণ পর কাছে আসতেই যথারীতি মেয়েরা সব
ঝাঁপিয়ে পড়লো মাছ দেখার জন্য। জেলেদের কাছে তেমন কিছু ছিল না; হেসে বলল,
দিদি আজ তেমন মাছ ওঠে নি জালে, সারাদিন খেটে তেমন কিছু পাই নাই। ওদের
একজনের কাছেই শুধু কেজি দু’য়েক সামুদ্রিক চুনো মাছ ছিল। তাই বার করে দেখাতে
লাগল। মেয়েরা সানন্দে তাই ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে কিনতে চাইল। যে জেলের মাছ
সেই যুবক জেলে হাসতে হাসতে সামান্য দরাদরি করে মাত্র শ’দেড়েক টাকায় ঐ কেজি
দু’এক চুনো মাছ নির্বিবাদে দিয়ে দিল এবং বলেও দিল কিভাবে ধোয়াধুয়ি করে
ভাজতে হবে। এরপর জেলেরা সব গুছিয়ে গাছিয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল,
আমি ওদের একটু পেছনেই হাঁটছিলাম। বাকিরা সবাই কিছুটা পিছনে হেঁটে আসছে।
জেলেরা কথা বলতে বলতে হাঁটছিল, মাছ বিক্রি করলো যে ছেলেটা, ওদের মধ্যে একজন
তাকে বলল– মাছগুলো দিয়ে দিলি.. এতো সস্তায়? ছেলেটা পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে
একটুখানি চুপ করে থেকে স্বগতোক্তির মতো বলে উঠলো–হ্যাঁ.. দিলাম। দেশের
মানুষকেই তো দিলাম। কোনও বিদেশীকে তো দিই নাই! কথাটা আমাদের সঙ্গের কেউ
শুনতে পায় নি, এক আমি ছাড়া। শুনে আমি যেন একটা ইলেকট্রিক শক খেলাম!
বোধবুদ্ধিতে কে যেন সপাং করে একটা চাবুক মারল! সত্যি তো! এভাবে তো আমরা
কখনও ভাবি না! আমি কেমন যেন ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে গেলাম। মনটা দমে গেছে।
হোটেলে ফিরে কাউকে কিছু বলতেও পারলাম না। শুধু মাথার মধ্যে কথাটা ঘুর ঘুর
করতে লাগল। পরে এটা নিয়ে অনেক ভেবে দেখেছি। শুধু মনে হয়েছে, দেশের এই সহজ
সরল হতদরিদ্র নিম্নবর্গীয় মানুষগুলোকে সত্যিই আমরা চিনি না! যাদেরকে আমরা
তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করি, হেয় জ্ঞান করি, দয়া দাক্ষিণ্য করি, নিজেদেরকে ওদের
উদ্ধারকর্তা ভাবি, সেই শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত মানুষ আমরা, শহুরে বাবুলোকরা
বোধহয় কোনোদিনই ওদের বোধের সীমানায় পৌঁছতে পারব না! ঘটনাটা হয়তো একটা তুচ্ছ
ঘটনা। প্রতিদিনই এরকম অনেক ঘটনা ঘটছে। আমরা কেয়ার করি না। কিন্তু কেয়ার না
করলেও এর পেছনে যে একটা গভীর দেশপ্রীতি, দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা,
সম্মান আছে, বিশেষ করে মেয়েদের প্রতি যে একটা বিশেষ শ্রদ্ধা আছে সে বিষয়ে
কোনও সন্দেহ নেই। আমি একশ ভাগ বিশ্বাস করি এখন। কারণ এই রকম আরও অনেক নজির
আছে আমার কাছে। কিন্তু প্রতিদানে আমরা কি দিই? কিছুই না। শুধু
বিশ্বাসঘাতকতা!! তা নিয়ে মনেহয় নতুন করে কিছু বলার নেই। ভাবলে অবাক হতে হয়,
লজ্জাবোধ হয়!
এখন এখানে একটা কথা তুললে ভীষণ বিতর্ক বেধে যাবে। সেটা হল ভারত আর
ইন্ডিয়া-দুটো দেশের কথা যা অনেকেই মানতে চাইবেন না। কিন্তু তাতে তো সত্যটা
পালটে যাবে না বা মিথ্যে হয়ে যাবে না। হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও সত্যটা সত্য-র
জায়গাতেই থেকে যাবে। সেটাই বাস্তব। সেই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার মতন মন
আছে কার? কোন শ্রেণীর মানুষের আছে? যাঁদের থাকার কথা তাঁরা তো অন্য স্বপ্নে
বিভোর! সে স্বপ্নের নাম গ্লোবালাইজেশান! খুব গালভরা নাম একটা! ভাবলে মনে
হয়,কি না কি একটা বিপ্লব ঘটে গেছে সারা বিশ্বে! সারা পৃথিবী এক হয়ে গেছে। এ
এক মস্ত ভুবনগ্রাম। এইসব হাবিজাবি অজস্র আবর্জনা সুলভ কথাবার্তা আমাদের
প্রতিনিয়ত গেলানো হচ্ছে যা হজম তো হচ্ছেই না উলটে বদ হজমের চোঁয়াঢেঁকুর ও
তার বিশ্রী পচা দুর্গন্ধে সামগ্রিক চিন্তার জগত, তার পরিবেশ বিষাক্ত হচ্ছে।
আসলে যে কি ঘটছে সেটা জানবার বা শোনবার মতন মন আছে কার? উন্নয়নের গুঁতোয়
সবাই এখন সামনের দিকে পড়িমরি করে ছুটছেন কি করে গ্লোবাল-মেল নামের
ট্রেনটাতে দ্রুত উঠে পড়া যায়, না হলে যে ইহজীবনের ভোগবাদটাই হয়ত ফসকে যাবে!
মনের মণিকোঠায় তাঁদের কারেন্সি হল ডলার, রাজধানীগুলো হল
লন্ডন-ওয়াশিংটন-টরেন্টো-মস্কো-বেজিং-টোকিও, ইউনিক গ্লোবাল পোশাক, ইউনিক
গ্লোবাল খাদ্য এমনকি ইউনিক একটা কালচারের প্রতি তীব্র আকর্ষণ–এক কথায়
নিজভূমে পরবাসী কিন্তু মনে মনে বিশ্বনাগরিক “ঘেঁটে ঘ” হওয়া আর সেই সঙ্গে
মেধা, প্রতিভার বিসর্জন, ব্রেন ড্রেন! এই হল পোশাকি বিশ্ব নাগরিকত্ব-র
চেহারা! এঁরা হচ্ছেন ইন্ডিয়ার আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক লোক নাকি নাগরিক জঙ্গল,
কে জানে? এঁরা পণ্য-মৈথুন মৌতাতে মেতে আছেন, বিরাট সংখ্যক প্রায় ২৫ কোটির
কনজিউমার ক্লাস যাঁদের দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দেশি-বিদেশী
বিনিয়োগকারীরা। ইন্ডিয়ার এই নাগরিকরা জলের বোতল আর সেল ফোন হাতে শপিংমলে
চরে বেড়ায় আর তখন ভারতের লোক ফুটো হাঁড়ি নিয়ে নদীর চরে জল খুঁজে বেড়ায়।
রাষ্ট্রের উচ্চপদাধিকারী আমলা ফ্রান্সের জনসাধারণকে অনুরোধ করে বলে
আসেন–আপনারা বলিউড দেখে ভারতকে চিনবেন না। এর চাইতে নির্মম সত্য আর কি হতে
পারে? এইখানেই ভাগাভাগিটা হয়ে যাচ্ছে–একটা দেশের মধ্যে আর একটা দেশ।
পাঁচহাজার বছরের পুরনো একটা দেশের যে সামাজিক বিধি ব্যবস্থা ছিল তা
ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল ঔপনিবেশিক কারণে অথচ গড়ে ওঠেনি উপযুক্ত নতুন কোনও
আধুনিক ব্যবস্থা–রাস্তা নেই, আলো নেই, পাণীয় জল নেই, স্কুল নেই, কলেজ নেই,
নেই হাসপাতাল–যেটুকু আছে তারও টিমটিমে করুণ অবস্থা। অনুদান যা আসে তাও বারো
ভূতে লুটেপুটে খায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার তার মধ্যে টুনি বাল্বের মতন আলো
ঠিকরচ্ছে কসমোপলিটান শহরগুলো যেখানে পাশাপাশি ভোগ আর উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে
চলছে। স্বভাবতই একটা বৈষম্য প্রকট, প্রান্তিক অঞ্চল আর একটা কসমোপলিটান
শহরের মধ্যে ব্যবস্থার আসমান জমিন ফারাক।
এ রকম অবস্থায় মধুসূদনরা কি করবে? শিক্ষার সার্বজনীন অধিকারের দাবীতে
শহরের বাবু-শ্রেণীর দ্বারা পরিচালিত কোনও রাজনৈতিক / অরাজনৈতিক সংগঠনের
ছত্রছায়ায় যাবে নাকি কোনোক্রমে শহরের এক কোনায় মাথা গুঁজে প্রাণপণ যুদ্ধ
চালাবে তার শিক্ষাটা সম্পূর্ণ করার জন্য? যারা বোঝে তারা ২য় পথটাই বেছে
নেয়, তাদের কাছে শিক্ষাটাই বড় অস্ত্র, অন্য কিছু নয়! তারা জানে অন্য যে
কোনও অস্ত্রের থেকে এই অস্ত্র অনেকবেশী শক্তিশালী। যেখানে সমস্ত আশা ক্ষীণ
হয়ে যায়, প্রশ্ন ওঠে কে দেবে আলো, কে দেবে আশা, কে যোগাবে ভরসা সেখানে
মধুসূদনদের এই লড়াই বৃহত্তর প্রেরণা যোগায় আর এক কোনও মেধাবী সতীর্থকে।
হয়তো ওরাই হবে ভারতবর্ষ নামক দেশটার ভবিষ্যৎ যারা হয়ে উঠবে স্ব-ভূমির
প্রকৃত উন্নয়নের দিশারী, যারা তাদের প্রান্তিক-উন্নয়ন দিয়ে ভোগবাদী
ইন্ডিয়াকে ঘিরে ফেলবে, সেদিন বোঝা যাবে মুখ আর মুখোশের পার্থক্য, উন্মুক্ত
হবে আমাদের প্রকৃত চরিত্র; সেদিনই শুরু হবে আমাদের স্বাধীনতা যোদ্ধাদের
অমলিন স্বপ্ন সফল হওয়া, বিদ্যাসাগরের অসমাপ্ত আরাধ্য কাজের জয়যাত্রা!!
–আম পাবলিক ব্লগারু