Tuesday, May 31, 2016

বিষয়ঃ শিল্প আলোচনা (৩)

প্রিয় পাঠক/ব্লগার,

বেঙ্গল আর্ট ইনিশিয়েটিভ-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

বাই-এর ২য় শিল্প আলোচনা সভায় লিফলেট ও প্রতিবেদন

 

পাল্টানো সময়ের ইতিবৃত্তান্ত সামাজিক প্রক্রীয়ায় উদ্গত মিথস্ক্রীয়ায় আক্রান্ত গোঁজামিল দেওয়া সমকালীন শিল্প-ইতিহাস ও তার চর্বিতচর্বণ ভাবনার বোঝাকে চ্যালেঞ্জ!

বাই-এর ২য় শিল্প আলোচনা সভায় এই লিফলেট-টা স্রোতা-দর্শকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। গতবারের আলোচনা সভার শুরুতে এই লেখাটা পাঠ করা হয়েছিল। পাঠ করেছিলেন অনুষ্ঠানের ঘোষক এবং সঞ্চালক পরাগ রায় (বাই-সদস্য)। লেখাটা সামান্য সংশোধন করে এবারে লিফলেট আকারে বিতরণ করা হয়। সাধারণভাবে কোনও আর্ট গ্রুপের একটা ইস্তাহার থাকে, যেহেতু জন্মের সাথে সাথে বেঙ্গল আর্ট ইনিশিয়েটিভ কোনো ইস্তাহার বা ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করে নি তাই এইরকম একটা ঘোষণাপত্রের মধ্য দিয়ে তার অভিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে গোটা শিল্প-পরিমন্ডলের সামনে হাজির করতে চায় সে। আজকের দিনে ইস্তাহার প্রকাশ করাটা একটা বিতর্কিত বিষয় বলে এবং এর কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা সে বিষয়ে বাই-সদস্যরা এখনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেন নি তাই ইস্তাহারের পরিবর্তে এই ঘোষণাপত্রটা প্রকাশ করা হয়েছে। বাই-এর সেক্রেটারী নবকুমার চক্রবর্তী কর্তৃক বাই-এর পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন পাঠের সময় এই কথাটা উল্লিখিত হয়েছে। নিচে ঘোষণাপত্র এবং ঐ প্রতিবেদনটা আমরা উপস্থিত করলাম। ধন্যবাদ!

–বাংলাব্লগ টিম

প্রিয় বন্ধুরা,
আজকের এই হালকা শীতের সন্ধ্যায় অবনীন্দ্র সভাগৃহে আয়োজিত নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান শুরুর প্রাকমুহূর্তে বেঙ্গল আর্ট ইনিশিয়েটিভ-এর তরফ থেকে আমরা দু-চারটে কথা বলতে চাই। বেঙ্গল আর্ট ইনিশিয়েটিভ একটি নবগঠিত শিল্পী-দল। মধ্য পঞ্চাশে দাঁড়িয়ে অর্নির্দিষ্ট, তমসাচ্ছন্ন, উদভ্রান্ত, উন্মার্গগামী, রুচিহীন একটা বিকারগ্রস্ত সংলাপ ও সময়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রমণ–একাকিত্বে বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত হতে হতে সেল-ফোনীয় তৎপরতায় গোলপার্কের অদূরে বিল্লাদার চায়ের দোকানে দীর্ঘ তিনবছরের আড্ডায় সবাইকে ডেকে এনে যুক্তি তক্কো গপ্পো চা সিগারেটের তুফানে মগ্ন হতে হতে হঠাৎ আকাঙ্খা জেগে ওঠে নিজেদের জন্য কিছু একটা করার। ছবি আঁকা তো চলছিল–নিজের নিজের স্টুডিওর দরজা বন্ধ করে। কিন্তু সে যে বড় একা একা–কে কি করি, কে কি ভাবি–কিছুই জানি না, বুঝি না! বোঝা দরকার জানা দরকার। আমরা বুঝতে চাইছিলাম। তাই জড়ো হওয়া। দল থাকলে দলাদলি থাকে, দলবদল থাকে, আমরা দলাদলিতে নেই কোলাকুলিতেও নেই! সহজ স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ মনোভাব নিয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে বুঝতে চাইছি এই পাল্টানো সময়ের ইতিবৃত্তান্ত সামাজিক প্রক্রীয়ায় উদ্গত মিথস্ক্রীয়ায় আক্রান্ত গোঁজামিল দেওয়া সমকালীন শিল্প-ইতিহাস ও তার চর্বিতচর্বণ ভাবনার বোঝা বহন করতে করতে ক্লান্ত অবসন্ন চিন্তার জগতে নবতর শিল্পভাষা অনুসন্ধানে দরকার নতুন রক্ত সঞ্চালনের–তরুণতর মনস্কতার যোগ্যতমদের দ্বারা পোস্টমর্টেম ও উৎখননকৃত সময়, ইতিহাস ও শিল্পের হাত ধরাধরি করে পথ চলার পাঁচালী। তাই তো প্রদর্শনী, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, ব্লগ, ওয়েবসাইট, ম্যাগাজিন, বুলেটিন–যুক্তি তক্কো গপ্পো, বিতর্ক সভার ভাবনা। প্রস্তুতি চলছে। এই অনুষ্ঠানই তার দ্বিতীয় প্রয়াস। লোকবল কম, অর্থবল কম–তবুও প্রাত্যহিকতার ঠ্যালা সামলাতে সামলাতে, সমগ্র শিল্পকলা পরিমণ্ডলের অন্তর্গত কূটকচালী, রাজনীতি, পেশাদারীত্বের রেশারেশি, প্রতিযোগীতা–এ সবে বিব্রত বোধ করি, অথবা এসব সহ্য করতে করতেই নিজেরাই স্ব-উদ্যোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হই। আর সে জন্যই আর্ট ইনিশিয়েটিভ। বেঙ্গল তার স্থানিক পরিচিতি। বাংলা তার ঠিকানা। আমাদের দরজা জানলা খোলাই আছে–লোকালেও আছি গ্লোবালেও আছি–হয়তো গ্লোকাল! আমরা হাত বাড়িয়ে আছি–হাত বাড়ালেই বন্ধুত্বতা! প্রশ্ন থাকলে উত্তর আছে উত্তর থাকলে প্রশ্ন আছে। আপনারা স্বাগত!
বেঙ্গল আর্ট ইনিশিয়েটিভ-এর সদস্যরা
১৮ ডিসেম্বর ২০১৫ কলকাতা

বাই-এর ২য় শিল্প আলোচনা সভায় বিতরিত লিফলেট
বাই-এর ২য় শিল্প আলোচনা সভায় বিতরিত লিফলেট


BAI Members
দলের পক্ষ থেকে বাই-এর সেক্রেটারী নবকুমার চক্রবর্তীর একটি প্রতিবেদন পাঠ।
ডানদিকে অপর একজন বাই-সদস্য সুমিত চৌধুরী ফটো তোলায় ব্যস্ত।

দলের পক্ষ থেকে বাই-এর সেক্রেটারী নবকুমার চক্রবর্তীর একটি প্রতিবেদন পাঠ

প্রিয় বন্ধুরা,
উৎস ছিল একটি চায়ের দোকান। প্রতি শনিবারের সান্ধ্যকালীন আড্ডার মৌতাত ও মাতামাতি, গুলতানী, চুলোচুলি, বকবকানী, প্রস্তাব, আবার প্রস্তাব, আলোচনা—এসব পার করতে করতে চার চারটি মজলীশ পেরিয়ে ২০১৪-র ১৫ আগস্টের পঞ্চম মজলীশের এক বৈঠকে বেঙ্গল আর্ট ইনিশিয়েটিভ অথবা ‘বাই’-এর জন্ম হয়। আট দশজন উৎসুক আড্ডাবাদী শিল্পীর প্রারম্ভিক প্রচেষ্টায় নবগঠিত বাই শুরু করে তার পথচলা। আড্ডার মধ্য দিয়ে তার জন্ম বলে সেই ধারায় আজও তার অস্তিত্ব টিঁকে আছে। সে এখন অনেকটা সংগঠিত। আটজন পূর্ণসদস্য ও কয়েকজন শুভাকাঙ্খীর অভিষ্ট কয়েকটি লক্ষ্যের প্রতি মর্যাদা রেখে সে সারা ভারতের বিভিন্নপ্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে চায়। বুঝতে চায় সামগ্রিকভাবে বহুমাত্রিক শিল্পকলা পরিমন্ডলের সমকালীনতা, ধরাশায়ী আর্টবাজার ব্যবস্থার মৌলিক সমস্যাকে, একই সঙ্গে চিনতে চায় বর্তমানের পরীক্ষা নিরীক্ষা নির্ভর নবরূপে রচিত শিল্পকলার আভ্যন্তরীণ কাঠামোটিকে যার মূল সুরটুকুকে মিলিয়ে নিতে চায় নিজের সঙ্গে। বাই জন্মের সাথে সাথে তার কোনও ইস্তাহার প্রকাশ করেনি ঠিকই তবে একটি প্রচারপত্রে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যর প্রাথমিক আভাস দেওয়া আছে। সেই প্রচারপত্রটি আজ আপনাদের হাতে তুলে দেওয়া হল। আপনারা পড়বেন, ভাববেন, প্রশ্ন রাখবেন, নানারকম প্রস্তাব দেবেন–ভবিষ্যতে এটাই আমাদের আশা। আমরা হাত বাড়িয়েই আছি। আসুন সংলাপ বিতর্ক যুক্তি তক্কো গপ্পোর আবহ নির্মাণ করে নতুন যুগের নতুন শিল্পভাষার অনুসন্ধানে আমরা ব্রতী হই। আপনাদেরকে অনেক শুভেচ্ছা জানাই। ধন্যবাদ।
–বেঙ্গল আর্ট ইনিশিয়েটিভের সদস্যরা
————————————————————————————————

*বাংলাব্লগের তরফে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করেছেন আমপাব্লিক ব্লগারু।

Posted in আলোচনা, শিল্প, সংবাদ | মন্তব্য দিন

বিষয়ঃ প্রদর্শনী

প্রিয় পাঠক/ব্লগার,

নবকুমার চক্রবর্তীর দিল্লীর ললিতকলা অ্যাকাডেমীতে কালোসাদা ছবির প্রদর্শনী

বাই সেক্রেটারী নবকুমার চক্রবর্তীর একটি কালোসাদা ছবি নিয়ে নয়া দিল্লীর ললিতকলা একাডেমীতে আজ থেকে একটি প্রদর্শনী শুরু হতে চলেছে । ৩৫ নম্বর ফিরোজ শা রোডে অবস্থিত রবীন্দ্রভবনের  তিনতলায় গ্যালারী-৮ এ এই প্রদর্শনী চলবে এই মাসের ১০ তারিখ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত। গতবছর এই শহরের ত্রিবেণী কলা কেন্দ্রে নবকুমারের প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, এবারে তাঁর দ্বিতীয় একক। গত বছরের ঐ প্রদর্শনী শিল্পী ও শিল্পপ্রেমীদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় হয়েছিল। অনেক কাজের মধ্যে থেকে একটি কাজ বিক্রিও হয়েছিল। এতে নবকুমার উৎসাহ নিয়ে স্টুডিওতে মগ্ন হয় আরও বেশী, এক বছর ধরে কালিকলম নিয়ে ফ্যাব্রিয়ানো নামে কাগজে ছোটো বড়ো মিলিয়ে প্রচুর ছবি এঁকে ফেলে কেননা ওর কাছে কালিকলম হল খুবই প্রিয় মাধ্যম। কিউরেটার কল্লোল রায়ের ক্যাটালগ রাইটিং এই প্রদর্শনীতে বাড়তি সংযোজন। দিল্লীবাসী অপর একজন অগ্রজ শিল্পীবন্ধু সৌমিত্রদা নবকুমারকে খুব সাহায্য করছেন প্রদর্শনীকে সফল করে তুলতে। বাংলাব্লগ এই প্রদর্শনীর সামগ্রিক সাফল্য কামনা করে দর্শকদের স্বাগত জানাচ্ছে প্রদর্শনীতে উপস্থিত হবার জন্য। ধন্যবাদ!

আমন্ত্রণ প্ত্র
আমন্ত্রণ প্ত্র

আরও কিছু প্রয়োজনীয় তথ্যর জন্য নীচের লিঙ্ক-এ ক্লিক করুন।
ব্লগ- বাংলাব্লগারু   /   বেঙ্গল আর্ট ইনিশিয়েটিভ

–বাংলাব্লগারু
Posted in আলোচনা, চিত্রকলা, শিল্প, সংবাদ | মন্তব্য দিন | সম্পাদনা

বিষয়ঃ ভ্রমণ


প্রিয় পাঠক/ব্লগার,

শিল্পী ভাস্কর রামকিংকরের বিখ্যাত ভাস্কর্য "ধান ঝাড়াই"
শিল্পী ভাস্কর রামকিংকরের বিখ্যাত ভাস্কর্য “ধান ঝাড়াই”


আধুনিক বাঙালীর তীর্থক্ষেত্র শান্তিনিকেতন
 

ভ্রমণ পিপাসু বাঙালীর কাছে শান্তিনিকেতন হল অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট। কিন্ত শিক্ষিত আধুনিক বাঙালীর কাছে শান্তিনিকেতন হল তীর্থক্ষেত্র। প্রবীণ মানুষদের কাছে যেমন বেনারস বা কাশীর যে গুরুত্ব তেমন গুরুত্ব আছে রবীন্দ্রনাথের মতন মনীষীর অপার কীর্তির উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত বেশ কয়েকটি প্রজন্মের বাঙালীর কাছে এ কথা বোধহয় আমরা আজ আর কেউই অস্বীকার করতে পারব না। সুতরাং সেই টানেই বারেবারেই ছুটে যাওয়া ওখানে। অনেকবারই যাওয়া হয়েছে, গত মাসেও একবার গিয়েছি। যখনই গিয়েছি কোনও না কোনো কাজ নিয়ে গিয়েছি। ঘুরেছি ফিরেছি, প্রদর্শনী করেছি, ছবি তুলেছি। কোনও উইক এন্ড কাটানো নয়, যাওয়ার কথা হলে মনটা নেচে উঠেছে নিছক এক মানসিক তৃপ্তির জন্য। সবসময় মনে হতো শান্তিনিকেতন কখনও পুরোনো হয় না আর আজকের দিনে আমাদের আছেটাই বা কি? রবি ঠাকুরকে বাদ দিলে তো বাঙালীর কোনও ভবিষ্যৎ নেই! অন্ততঃ এখনও পর্যন্ত সেইরকম কোনও বাঙালীর জন্ম হয় নি যিনি আমাদের সমস্ত ধ্যানধারণাকে পাল্টে দিতে পারেন! অসাধারণ এক প্রাজ্ঞতা নিয়ে তিনি যে পরিবেশ পরিমণ্ডলটা গড়ে তুলেছিলেন তার ছোঁয়া পেয়ে তাঁর মৃত্যুর ৬০-৭০ বছর পর জন্ম নেওয়া এখনকার প্রজন্মের এক বছর কুড়ির ছেলের মনও যে নাড়া খেয়ে যায়, সেটা ভাবলে বোঝা যায় যে তাঁর চিন্তাশক্তির ক্ষমতা কি অসীম ছিল যে আজও তা সমানভাবে সক্রিয়! দূর থেকে দেখা নয়, শুধু পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে নয় রবীন্দ্রনাথকে জানতে হলে আজকের প্রজন্মের কোনও নবাগতকে তাঁর কীর্তির সান্নিধ্যে এনে দেওয়া উচিত এই কথা ভেবেই এই পারিবারিক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে হাজির হওয়া শান্তিনিকেতনে। পাঁচদিনের ভ্রমণে কলাভবন, সঙ্গীতভবন, মিউজিয়াম, নন্দন আর্টগ্যালারী, প্রতীচী ট্রাস্ট, সোনাঝুরি, হাট, খোয়াই, কোপাই, প্রান্তিক স্টেশান ও কংকালীতলা অবধি যাতায়াত সম্ভব হয়েছে, আরও অনেক কিছু বাকী রইল ভবিষ্যতের জন্য। এই পাঁচদিনের ভ্রমণে অনেক ছবি তোলা হয়েছে, তার থেকে কিছু বাছাই করে এখানে দেওয়া হল।

পাঁচদিনের পথ পরিক্রমা

পাঁচ দিনের জন্য গেস্ট হাউসে ঘাঁটি গেড়ে থেকে নিজেদের ইচ্ছেমতন খাওয়া ঘুম বা অবসর উপভোগ করতে করতে আমরা বেরিয়ে পড়েছি ঘুরতে। রাস্তাঘাটে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রচুর টোটো, তাতে চড়ে টো টো করে ঘুরেছি, চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মেরেছি, আমাদের মতন অনেক ট্যুরিস্টদের সঙ্গে গল্প গুজব হয়েছে, তার মধ্যে এমন লোকেরও সন্ধান পাওয়া গেছে যিনি বাউল গান নিয়ে মেতে থাকেন। বাউলদের বিভিন্ন আখড়ায় সুযোগ পেলেই তিনি হাজির হন বাউল গান শোনার জন্য। স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলে বেশ মজা পাওয়া যায়—বীরভূম অঞ্চলের কথ্য বাংলার অদ্ভুত টানে কথা শুনতে ভাল লাগে, মাটির গন্ধ যেন তাতে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায় যে অভাব অভিযোগ আছে কিন্তু বিশ্বভারতী সহ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁদের মনে অসীম শ্রদ্ধা আছে। শান্তিনিকেতন যে কলুষিত হচ্ছে না তা নয় –- সে তো কলকাতায় বসে খবরের কাগজেই আমরা পড়ি, তবুও একটা চেষ্টা আছে শান্তিনিকেতনকে তার প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেবার। রাষ্ট্রের চোখে সে তো নয়নের মণি, তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নজর এড়ায় না।

আমরা বীরভূম গেস্ট হাউসে ছিলাম, গেস্ট হাউসটা সুন্দর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, গেস্ট হাউসের মালিক দেবুদা থেকে হাউসের কর্মচারীদের ব্যবহার খুবই সচ্ছন্দ, একটা হোমলি অ্যাটমোস্ফিয়ার আছে। ঠিক যেমন ট্যুরিস্টদের সঙ্গে হোটেল, দোকানদার বা রাস্তাঘাটের মানুষ, টোটো থেকে রিকশা চালকদের ব্যবহার বেশ নম্র-ভদ্র। ব্যতিক্রম নেই সেকথা বলব না তবে সেটা বাড়াবাড়ি রকমের নয়।

ভোরের শান্তিনিকেতন অসাধারণ, মনোমুগ্ধকর! বড়বড় বৃক্ষরাজিতে ভরা শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে দারুণ মজা লাগে। গেস্ট হাউসের উল্টোদিকের একটা চায়ের দোকানে বসে চা জলখাবার খেতে খেতে আমরা সকালের শান্তিনিকেতন উপভোগ করতাম! আর খালপাড়ের বউদির হোটেলে শস্তার সুস্বাদু মিল ছিল আমাদের রোজকার দুপুরের আহার। এই পূর্বাশা হোটেলের খুব নাম, দূর দূরান্ত থেকে লোকে খেতে আসে। এই খালপাড়ের কাছেই সোনাঝুরি আর সেই বিখ্যাত খোয়াই—যার পাড়ে অদ্ভুত সব ফর্ম অথবা ন্যাচারাল আর্কিটেকচার দেখে ছবি তোলায় নেশা ধরে যায়। এই খোয়াই-এর পাড়ে একটা হাট বসে প্রতি শনিবার, দুপুর ২টো থেকে সন্ধ্যা ৬টা অবধি এই হাটে জমজমাট ভীড় হয়, কেনাবেচা চলে নানারকম ক্রাফট, জামাকাপড় থেকে কাঠের জিনিস, মণিহারী জিনিস, বাউলদের মনমাতানো গান মাতিয়ে রাখে সারাক্ষণ। শহর থেকে আসা বয়স্ক মানুষ ও এখনকার প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের দেখেছি অবাক হয়ে বাউলের গান শুনতে, চোখে মুখে ফুটে ওঠা আনন্দ দেখে মনেহয় যেন শিকড়ের খোঁজে এখানে আসা। স্রোতারা গান শুনছেন, রেকর্ড করছেন, ভিডিও তুলছেন আবার প্রচুর ডোনেশান দিচ্ছেন বাউলদের—এটাই দেখবার মত বিষয় যে আমাদের ট্রাডিশানের ব্যাপারে সাধারণ শহুরে মানুষদের মধ্যে একটা বিরাট সচেতনতা তৈরী হয়েছে।

সোনাঝুরির কাছেই আছে প্রয়াত শিক্ষক ও শিল্পী বাঁধন দাসের বাড়ী (যেখানে বাঁধনদাও একটা হাট চালু করেছিলেন), স্বাদ এবং বসুন্ধরা আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট সেন্টার। স্বাদ (এস এস ভি এ ডি বা শান্তিনিকেতন সোসাইটি অফ ভিস্যুয়াল আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন) – যে প্রতিষ্ঠানকে বিশিষ্ট শিল্পী যোগেন চৌধুরীর নেতৃত্বে শান্তিনিকেতনে বসবাসকারী শিল্পী এবং কলাভবনের অধ্যাপকরা গড়ে তুলেছেন একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান হিসাবে। দেশ বিদেশ থেকে আসা নানান শিল্পী এখানে ওয়ার্কশপ, প্রদর্শনী করে থাকেন। এই প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে গুণীজনদের সংবর্ধনা ও পুরস্কার দেওয়া হয়। ভবিষ্যতের শিল্পীদের পক্ষে এই শিল্প-কেন্দ্র যে একটা বড়সড় ভূমিকা নেবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

একদিন পরিচ্ছন্ন প্রান্তিক স্টেশান পেরিয়ে আমরা কঙ্কালীতলায় গেলাম। কঙ্কালীতলা বাহান্ন পীঠেরএক পীঠ। মন্দির দর্শন সেরে আশপাশ ঘুরে কোপাই নদী দেখলাম। সংকীর্ণ কোপাই-এর পাড় পাথর দিয়ে বাঁধানো রয়েছে দেখলাম। এখান থেকে ফেরার পথে বিশ্ববাংলা-র সেন্টার দেখলাম। সুন্দরভাবে গড়ে তোলা হয়েছে সেন্টার-টা। তবে আমরা যখন গিয়েছি তখন দোকানপাট খোলে নি তখনো। ফলে কেনাকাটা কিছু হয় নি, বরং সোনাঝুরির হাট থেকে অনেক কিছু কেনা হয়েছে। পরিবারের তরফ থেকে এই কেনাকাটায় মূল উদ্যোগ ছিল আমার স্ত্রী ছন্দার, সঙ্গে ছিল আমার পুত্র নির্মাল্য, ওদের দু’জনের এই ভ্রমণপর্ব ভীষণ ভালো লেগেছে জেনে আমার একটা সোয়াস্তি ছিল। কলাভবন চত্বরে সংরক্ষিত প্রবাদপ্রতিম শিল্পী-ভাস্কর রামকিংকরের গড়া ভাস্কর্যগুলো ঘুরেফিরে দেখতে হয়েছে, দেখতে হয়েছে আর এক প্রবাদপ্রতিম শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের গড়া বিশাল মিউরাল (কলাভবন ক্যান্টিন-এর দেয়াল), ছাত্রাবাসের কাজগুলো, সোমনাথ হোড় ও মানিদা’র করা মিউরাল এবং আরও অনেকের করা লোহা বা স্টীলে তৈরী স্কাল্পচার – এসব যত দেখেছি ততই মন আবেগঘন হয়ে উঠেছে। এর আগেও অনেকবার দেখেছি কিন্তু ফিরে ফিরে দেখার মধ্যে যে অন্য ভালো লাগা আছে সেকথা অনুভূতিতে ধরা দিল। আমার উদ্দেশ্য ছিল আমার ছেলেকে এইসব অসাধারণ সৃষ্টিগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার, ওর ভালোলাগা দেখে বুঝলাম আমার কাজ সার্থক হয়েছে। আরও অনেককিছু দেখার ইচ্ছা ছিল আমাদের কিন্তু পাঁচদিনের পর্ব শেষে একটা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত মন নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসতে হল। বাসনা রইল অদূর ভবিষ্যতে আবার শান্তিনিকেতনে যাবার।

* একটা কথা জানিয়ে রাখি যে, যদিও এটা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক তবুও না বলে পারছি না যে শান্তিনিকেতনের কোথাও কোনও কাক আমরা দেখতে পাইনি। এই অদ্ভুত ঘটনাটা আমরা লক্ষ্য করেছি। জানিনা এর কি কারণ, তবে জানতে হবে।

বিগত দিনের পরিক্রমা

গতমাসে অর্থাৎ ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমি আর আমার বন্ধু নবকুমার দু’দিনের জন্য শান্তিনিকেতনে হাজির হয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল স্বাদ এবং নন্দন আর্ট গ্যালারী ভিজিট করা আর কিছু দরকারী কাজকর্ম সারা। এর সঙ্গে ছিল নন্দন আর্ট গ্যালারীতে আমাদের এক বন্ধুর স্ত্রীর চিত্র প্রদর্শনী দেখা। সেইমত গণদেবতা এক্সপ্রেস ধরে সকাল সকাল শান্তিনিকেতনে হাজির হয়ে দরকারী কাজগুলো মিটিয়ে নিলাম। প্রথমে স্বাদ-এ উপস্থিত হয়ে স্বাদ-এর পরিচালক শ্রীমতি জয়লক্ষ্মী সিংহ রায়-এর সঙ্গে দেখা করলাম, তিনি খুব আতিথেয়তা করলেন, অনেক কথাবার্তা হল তারপর স্বাদ আয়োজিত একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী দেখলাম, খুব ভালো ভালো কাজ চোখে পড়ল। নীচের বেসমেন্টের ওয়ার্কশপে কয়েকজন উঠিত শিল্পী কাজ করছেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হল অনেক কথাবার্তা হল। ২০১৩-তে এখানে আমরা প্রদর্শনী করেছিলাম। দেখলাম স্বাদ-এর পাশে একটা গোটা বাড়ীকে অত্যাধুনিক চেহারার গ্রাফিক্স স্টুডিওতে পরিণত করেছেন স্বাদ-এর পরিচালক বর্গ। এরপর হোটেল পূর্বাশায় দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি সোনাঝুরি হাট এবং নন্দন আর্ট গ্যালারীর উদ্দেশ্যে। সোনাঝুরি হাট দেখতে গিয়ে খোয়াই-এর পাড় দেখার জন্য খাদের মধ্যে নেমে পড়ি আমি আর নব। ঘুরতে ঘুরতে দেখতে থাকি, লোভ সামলাতে পারিনি, মোবাইল ক্যামেরাতে একের পর এক ছবি তুলতে থাকি। সে কি অসাধারণ বিচিত্র নৈসর্গিক স্থাপত্য, যেমন তার ভাঙন, তেমনি তার মোচড়, কার্ভেচার, মাটির অদ্ভুত সব ফর্ম। তার মধ্যে মধ্যে রোদ্দুরের খেলা, গাছপালা, পাখির কলরব। নব তো প্রকৃতি-পাগল, সঙ্গের ক্যামেরা ফোকাস করে একের পর এক ছবি তুলে গেছে। আমার উদ্দেশ্য ছিল একটা বিশেষ প্রয়োজনে গ্রাউন্ড লেভেল থেকে ছবি নেওয়া, সেটা করতে করতে খোয়াই-এর দেয়ালেরও ছবি আর ভিডিও তুলতে থাকি। এইসব করতে করতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, আমরা তাড়াতাড়ি হাটে এসে কিছু খুঁটিনাটি জিনিস বিশেষ করে গ্রামীণ ক্রাফট আইটেমগুলো দেখে নিয়ে, খানিকটা সময় বাউলদের গান শুনে নিয়ে কলাভবনের দিকে হাঁটা দিই। ওখানে নন্দন আর্ট গ্যালারীতে শুক্তি রায়ের শিল্পকলা প্রদর্শনী চলছিল। শুক্তির হাসব্যান্ড চয়নও ওখানে ছিল। দেখা হল দুজনের সঙ্গেই। আমরা প্রদর্শনী দেখলাম। অনেক আড্ডা হল। নব আর আমি প্রচুর ছবি তুললাম, ভিডিও তুললাম। এরপর আমার ইচ্ছা ছিল সারাদিনের ক্লান্তিকর হাঁটাহাঁটির পর একটু রসেবসে থাকা, কিন্তু বেশী টাকাপয়সা সঙ্গে না থাকায় ঐ আশা পরিত্যক্ত হয়। শুক্তি আর চয়ন গেস্ট হাউসে ফিরে গেল আমরাও আমাদের বীরভূম গেস্ট হাউসে ফিরে আসি, উল্টো দিকের চায়ের দোকানে বসে চা তেলেভাজা খেয়ে গল্পগুজব করতে করতে সন্ধ্যেটা কাটিয়ে দিয়ে রাত ন’টার সময় বৌদির হোটেলে রাতের খাওয়া সেরে নিয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে প্রান্তিক স্টেশানের দিকে কিছুদূর গেলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে হাঁটতে ভালই লাগছিল। চারদিকে নিশুতি রাত আর মাথার উপর গোলাকার চাঁদ, অপূর্ব সে দৃশ্য! মনে রাখার মতন।

পরদিন ছিল রোববার। সাত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে চা জলখাবার খেয়ে নিয়ে আমরা সোজা চলে যাই খালপাড়ের কাছে নেচার ইন্টারপ্রিটেশান সেন্টার-এর কাছে, ওখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করতে করতে আমরা পৌঁছে যাই লালবাঁধে। ২০১৩-তে প্রথমবার এখানে ঘুরে এসেছিলাম। ভীষণ ভালো লেগেছিল। বিশাল একটা জলাশয়, তাতে একদিকে ধোপারা কাপড় কাচছেন আর একদিকে পাখ পাখালি টল টলে   জল, ঝলমলে রোদ্দুর! আশপাশে কাঁকর নুড়ি মেশানো লাল মাটির জমি, পায়ে হাঁটা পথ। মাঝে মাঝে লম্বা লম্বা ঘাসের গোছা, দেখলেই বোঝা যায় এই রাঢ় বাংলার দৃশ্য নন্দলান, রামকিঙ্কর বা বিনোদবিহারীর কাজে কতটা প্রভাব ফেলেছিল। ওঁরা যে এখানে আসতেন, আউটডোর করতেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। লালবাঁধের এই দৃশ্য দেখলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে নন্দলাল বা রামকিঙ্ককরের ছবি। নব’র ক্যামেরার শাটার তো ওঠানামা করে যাচ্ছেই আমিও আমার মোবাইল ক্যামেরায় ছবি আর ভিডিও তুলে রাখছি। গ্রাউন্ড লেভেলে জমির ছবি, নানা রকম টেক্সচারের ছবি আমার দরকার বলে প্রচুর ভিডিও করলাম, স্টীল ইমেজও নিতে থাকলাম। লালবাঁধ হচ্ছে শ্যামবাটীর পিছনে। শ্যামবাটীর রাস্তা থেকে জলাশয় অবধি একটা বিরাট লালমাটি নুড়ি কাঁকরের প্রান্তর, এখানে শান্তিনিকেতনের শিল্পীদের করা অনেকগুলো আকর্ষণীয় ওপেন এয়ার আর্ট অবজেক্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, এর নাম দেওয়া হয়েছে “লালবাঁধ ইকো-জোন, এনভায়রনমেন্টাল স্কাল্পচার পার্ক ”, ২০১৪-র ৯ আগস্ট এর উদ্বোধন করেছেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য শ্রী সুশান্ত দত্তগুপ্ত। এই জায়গাতে আমাদের ছবি ভিডিও তোলাটা   এমন এক পাগলামীতে পৌঁছেছিলো যে একজন সিকিউরিটি গার্ড তো উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে লাগলো এরা করে কি?! আসলে শরীরের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে মাটির দিকে তাক করে আমি ভিডিও রেকর্ডিং করছিলাম, একজায়গায় বোঁ বোঁ করে এমন ঘুরপাক খেতে লাগলাম যে ঐ সিকিউরিটি গার্ডের হয়তো মনে হয়েছে যে আমার শরীর টরীর নিশ্চয়ই খারাপ হয়েছে! প্রকৃতিও যে কাউকে পাগল বানাতে পারে এটা আমি সেদিন অনুভব করলাম! আমার প্রয়োজনীয় শটস নিয়ে আমি খুব খুশী হয়েছি আর নবকুমার যে কত পাখীর ছবি তুলল তার ইয়ত্তা নেই! এইসব করতে করতে আমরা দুপুরের মধ্যে গেস্ট হাউসে ফিরে এলাম।

গেস্ট হাউসে ফিরে স্নান সেরে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিয়ে গেস্ট হাউস ছেড়ে একেবারে আমরা বেরিয়ে এলাম এবং শুক্তির প্রদর্শনীতে গিয়ে হাজির হলাম, কেননা আগের দিন বেশীক্ষণ থাকা হয় নি, আজকে অনেকক্ষণ থাকার ইচ্ছা। এছাড়া সন্ধ্যা ৬ টার গণপতি এক্সপ্রেসে ফেরার টিকিট রিজার্ভেশান, হাতে ঘন্টা কয়েক সময় পাওয়া যাবে আড্ডা মারার জন্য। প্রদর্শনী হলে ব্যাগ রেখে নব, আমি আর চয়ন কলাভবনের কাছাকাছি মাটির হোটেলে মাছভাত খেয়ে এলাম, চয়নই বিল পেমেন্ট করলো। এদিক ওদিক একটু ঘোরাঘুরি করে শুক্তির জন্য কিছু কিনে নিয়ে হলে এসে দেখি লালা বসে আছে। লালা আমাদের পুরনো বন্ধু। সেই কবে আর্ট কলেজে অ্যাডমিশানের সময় লালার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। তারপর কলেজ পর্ব মিটলে ৮০-র দশকে যে একদল সদ্য পাশ করা আর্টিস্ট শান্তিনিকেতনে এসে ঘাঁটি গাড়ে লালা তাদের মধ্যে একজন। লালারা এখানে থাকতে শুরু করে, ছবি আঁকাও চলতে থাকে, পরে ওরা সোনাঝুরির আশপাশে সাঁওতাল গ্রামের কাছাকাছি জমি কিনে মাটির বাড়ী বানিয়ে থাকতে শুরু করে। সেই বাড়ী আজও আছে। লালার পাকাপোক্ত মাটির বাড়ী এই ২০১৩-তে গিয়ে আমি প্রথম দেখি। শান্তিনিকেতনকে সেন্টার করে লালা বম্বে-কলকাতা- দিল্লীতে যাওয়া আসা করে পেশাদারীত্বের কারণে। মূলতঃ ছবি বিক্রী ও কমিশান ওয়ার্ক করেই লালার সংসার চলে। লালা বিবাহিত, ওর স্ত্রীর নাম মঞ্জুরী। তবে এই দম্পতি কখনো দিল্লী কখনো শান্তিনিকেতনে থাকে। সেই লালার সঙ্গে ২০১৩-র পর আবার দেখা। পুরনো অনেক কথাবার্তা হল। আমাদের আর এক বন্ধু যীশুর কথা উঠল। সে আর বেঁচে নেই। কয়েকমাস হল যীশু আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। লালা ওর সম্পর্কে কিছু বলল। দিল্লীতে থাকাকালীন ওদের যোগাযোগ ছিল। যাইহোক, নন্দন আর্ট গ্যালারীতে শুক্তির প্রদর্শনীর খবর পেয়ে লালা হাজির হয়েছে; আসলে শুক্তি ও চয়ন লালাদেরও পুরনো বন্ধু। আগেরদিন শুক্তির একজিবিশানের উপর অনেক ছবি তুলেছিলাম, আজও কিছু তুললাম। ওরা জানালো প্রদর্শনী উদ্বোধনের দিন ভালো ভীড় হয়েছে, বিশ্বভারতী থেকে অনেকেই এসেছেন, এছাড়া রোজই ফ্লাইং দর্শকদের ভালো ভীড় হয়েছে। পরদিন শুক্তির প্রদর্শনী শেষ হবে। আমরা তো থাকব না। আজই ফিরতে হবে। বিকেল হয়ে আসছে, তাই রেডি হতে শুরু করলাম। নীচের কক্ষে কলাভবন আয়োজিত শিল্পী-ভাস্কর বিকাশ দেবনাথ-এর প্রদর্শনী চলছিল, আমরা একবার দেখে নিলাম। বিদায় নেবার সময় লালা সবাইকে একবার জড়িয়ে ধরল। আমরাও বেরিয়ে পড়লাম। একটা টোটো নিয়ে বোলপুর স্টেশানের দিকে রওনা দিলাম। মনটা স্বভাবতই ভারাক্রান্ত! শরীর ক্লান্ত ছিল, খানিকটা ঝিমোতে ঝিমোতে গণপতি এক্সপ্রেস ধরে হাওড়ায় নামলাম। তারপর যে যার বাড়ী। এর ঠিক একমাস বাদেই আবার হাজির হলাম শান্তিনিকেতনে একটা পারিবারিক ভ্রমণের উদ্দেশ্য যার কথা এই লেখার গোড়াতেই দেওয়া আছে। আর দেওয়া রইলো প্রচুর ছবি, পাঠকের ভাল লাগলে আমার পরিশ্রম সার্থক হবে। আপনাদের জন্য শুভেচ্ছা রইলো। ধন্যবাদ!
ফটোগ্রাফি-  উল্লিখিত ছবিগুলো ছাড়া বাকী সমস্ত ছবি লেখকের তোলা।

বি.দ্রঃ - প্রচুর ছবি আপ্লোড করা আছে। আপনারা দেখতে চাইলে নিচের লিংকে ক্লিক করুন। বাংলাব্লগের ওয়ার্ডপ্রেশ স্লাইডারের মাধ্যমে ছবি দেখতে পাবেন। 

বিষয়ঃ ভ্রমণ

–- নীলোৎপল সিংহ
Posted in ভ্রমণ, সাহিত্য | Tagged , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , | মন্তব্য দিন | সম্পাদনা

Monday, May 30, 2016

বিষয়ঃ শিল্প আলোচনা

প্রিয় পাঠক/ব্লগার,

বাই-এর দ্বিতীয় শিল্প আলোচনা সভা

পোস্টার
পোস্টার


দীর্ঘ এক বছর প্রতীক্ষার পর বাই (বেঙ্গল আর্ট ইনিশিয়েটিভ) আবার একটি শিল্প আলোচনা সভার আয়োজন করতে চলেছে চারুকলা ভবনের অবনীন্দ্র সভাগৃহে এই মাসের ১৮ তারিখে। গতবছর ঠিক এই শীতের মুখে বাই-এর সদস্যরা তাঁদের প্রথম আলোচনা সভাটি বসিয়েছিলেন এই সভাগৃহে। আগামী ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫ বিকাল ৫-৩০ থেকে রাত ৯ টা অবধি চলবে এই সভা এবং এটি তাঁদের দ্বিতীয় অনুষ্ঠান। এই আলোচনা সভায় বক্তা হিসাবে উপস্থিত থাকবেন শিল্পী পার্থ দাশগুপ্ত যিনি সিরামিক মাধ্যমের একজন দক্ষ শিল্পী হিসাবে শিল্প রচনা করে থাকেন ইতিমধ্যেই নাম করেছেন এবং শিল্প ও উৎসবের মেলবন্ধনে শারদ উৎসবের মন্ডপ নির্মানে বিরাট সাড়া ফেলে দিয়েছেন। পার্থ তাঁর সৃষ্ট সিরামিক শিল্প নিয়ে কথা বলবেন। অপরজন শিল্পী ও শিল্প আলোচক তপন ভট্টাচার্য যিনি দীর্ঘদিন ধরে একটি ভিন্ন ধারায় ভারত, বাংলা ও দেশী বিদেশী শিল্পকলার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা করে আসছেন এবং বর্তমানে তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে সেমিনারে ডাকও পাচ্ছেন শিল্পকলা নিয়ে বক্তৃতা করার জন্য। এছাড়া তিনি আবার একই সঙ্গে একজন শিল্পীও বটে, ছবি আঁকেন গ্যালারীতে শো করেন। তপন ভট্টাচার্য সমকালীন শিল্পকলা ও তার সমস্যা নিয়ে কথা বলবেন যদিও উভয় বক্তাই সমকালীন শিল্পকলার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনায় ব্যাপৃত থাকবেন। এই আলোচনার সঞ্চালক বা মডারেটার হিসাবে উপস্থিত থাকবেন অধ্যাপক সুনন্দকুমার সান্যাল যিনি বোস্টন আর্ট ইনিস্টিটিউট-এ ক্রিটিকাল আর্ট হিস্ট্রি নিয়ে অধ্যাপনা করেন। এই অধ্যাপকই গতবছর বাই-এর আর্ট টক শো-তে সমকালীন পৃথিবীর ঠিক পশ্চিমী নন এমন কয়েকজন শিল্পীর অতি আধুনিক শিল্পনির্মান নিয়ে একটি মনোজ্ঞ আলোচনা করেছিলেন। আলোচনার শুরুতে বাই-এর পক্ষ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন পাঠের পর মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে। বাংলাব্লগ বাই-এর সহযোগী হিসাবে সমস্ত প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছে তাই এই অনুষ্ঠানের একটি প্রতিবেদন আগামীদিনে প্রকাশ করবে। আমরা বাংলাব্লগের পক্ষ থেকে সমস্ত পাঠক/ব্লগার/শ্রোতাদের কাছে আবেদন করছি এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য। ধন্যবাদ!

–বাংলাব্লগ টিম
Posted in শিল্প, সংবাদ | Tagged , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , | মন্তব্য দিন

বিষয় : সংবাদ

প্রিয় পাঠক/ব্লগার,

কে দেবে আলো, কে দেবে

আশা, কে যোগাবে ভরসা !..?

বছর কয়েক আগের কথা। সেদিন ছিল শুক্রবার। মধ্যরাত্রি। আকাশবাণীর ‘অনেক কথা বলার ছিলো’ অনুষ্ঠান শুনছি। যেমন গত দশ বছরের উপর প্রায় অনুষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকেই এই অনুষ্ঠান শুনে আসছি। কত মানুষের কত সমস্যার কথা মনের কথা। ফোন, এসএমএস, চিঠি, ই-মেল- এগুলোর মাধ্যমে অনুষ্ঠান-সঞ্চালকের কাছে পৌঁছে যায় একের পর এক সমস্যার কথা। সঞ্চালক চেষ্টা করেন যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে প্রতিটি সমস্যার সমাধান বা পরামর্শ দেওয়ার। অনেক সময় অনেক অভিজ্ঞ মানুষরাও এগিয়ে আসেন সুপরামর্শ দেওয়ার জন্য। হাত বাড়িয়ে দেন সাহায্যের জন্য। শ্রোতারাও সারা সপ্তাহ ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন এই অনুষ্ঠানটির জন্য। এ যেন স্টেথোস্কোপের মতন সমাজের গভীরতম তলদেশ থেকে তুলে আনে হৃদয়ের স্পন্দন! কত দু:খ কত বেদনা কত যন্ত্রণা আবার সাফল্যের হার্ট বিট্ মেশানো সাংকেতিক আবহ।

এরকমই একটি চিঠি পাঠ করছিলেন অনুষ্ঠান-সঞ্চালক। চিঠিটির প্রেরক একজন ছাত্র। নাম মধুসূদন গোঁড়া। অভিভাবকের নাম জয়দেব গোঁড়া। বাড়ী হাওড়া-উলুবেড়িয়ার বীরশিবপুর অঞ্চলে। চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি মধুসূদন চাষী পরিবারের সন্তান। মধুসূদনের পরিবার অসম্ভব দরিদ্র। ক্ষেত মজুরী করে কোনোক্রমে দিন চলে তাঁদের। পড়াশোনার পাশাপাশি চাষের কাজে যুক্ত হতে হয় মধুসূদনকে। মধুসূদনের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট খুব ভালো। কয়েকটি টিউশান করে মধুসূদন যে টাকা পেতো তার অনেকটাই তাকে বাড়ীর সদস্যদের চাপে সংসারে দিয়ে দিতে হতো। ফলে সামান্য যা কিছু থাকতো তা দিয়েই সে পড়াশোনার কাজ চালাতো। এই অবস্থার মধ্য দিয়েই সে প্রথমবার জয়েন্ট এনট্রান্স পরীক্ষায় সফল হয় এবং জেনারেল কোটায় ১১০০তম স্থান অধিকার করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রনিক্স ইন্জিনিয়ারিং-এ প্রথমবর্ষে ভর্তি হয়। কিন্তু অর্থাভাবে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। মধুসূদন ফিরে আসে এবং স্থানীয় কলেজে ভর্তি হয়। কিন্তু তাও সম্ভব হয় না অর্থাভাবে। এবারও পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় মধুসূদনের। ইতিমধ্যে মধুসূদন একটি টিউশান বাড়ীর সহযোগিতায় দ্বিতীয়বার জয়েন্ট এনট্রান্স পরীক্ষায় বসে এবং জেনারেল কোটায় ৭০০তম এবং এস সি কোটায় ৩৭তম স্থানাধীকারী হয়ে ঐ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েই কমপিউটার সায়েন্স নিয়ে প্রথমবর্ষে ভর্তি হয়। এখন প্রচন্ড অর্থাভাবে সে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে অক্ষম তাই মধুসূদন ঐ চিঠির মাধ্যমে একটি আবেদন জানিয়েছে যে কেউ যদি বিনা অর্থে বা সামান্য টাকার বিনিময়ে তাকে থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেন তাহলে তার পড়াশোনাটা সে চালিয়ে যেতে পারবে।

এ পর্যন্ত শুনে আমরা শ্রোতারা স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। কি করা যায় কি করা উচিত এসব ভাবছি। ইতিমধ্যে সঞ্চালক একটি গান চালিয়ে দিয়েছেন। গানটি শেষ হবার সাথে সাথে সঞ্চালক আমাদের জানালেন যে গানটি চলাকালীন দু-জন শ্রোতা-বন্ধু ফোনে যোগাযোগ করে মধুসূদনের ফোন নাম্বার চেয়েছেন, তাঁরা মধুসূদনের সঙ্গে কথা বলতে চান। এর কিছুক্ষণ পরে একজন মহিলা শ্রোতা-বন্ধু ফোন করলেন এবং তিনি কিছু বলছিলেন যা আমার রেডিওর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ভালো করে শুনতে পারি নি। কিন্তু পরে সঞ্চালক আমাদের জানালেন যে ঐ শ্রোতা-বন্ধু মধুসূদনকে আশ্বস্ত করেছেন এবং জানিয়েছেন যে মধুসূদন যেন চিন্তা না করে, দিদি ঠিক সময়ে তার কাছে পৌঁছে যাবে। আমরা শ্রোতারা কিছুটা আশ্বস্ত হলাম এবং বুঝলাম যে পৃথিবীটা এখনও শুকিয়ে যায় নি–প্রকৃত মানুষরা আজও আছেন! তবে তাঁরা সংখ্যায় খুবই নগণ্য। আর তাঁদের সামর্থ্যই বা কতটুকু? এতো ধূ ধূ মরুভূমির বুকে একফোঁটা বৃষ্টির মতন। তবুও যাহোক মধুসূদনরা আজও এইসব সংবেদনশীল মানুষদের সহযোগিতা টুকু পেয়ে একটু একটু করে এগোতে পারছে এটা ভেবে খানিকটা স্বস্তি পাই আমরা।

এইখানেই হয়ত থেমে যাওয়া যেত। এরকম অনেক ঘটনার আর একটি ঘটনার সংযোজন বলে এড়িয়ে যাওয়া যেত। কেননা এই ধরণের ঘটনার কথা আমরা অহরহ শুনতে পাই,আর শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেছি। কেমন যেন গা সহা হয়ে গেছে। আমরা যেন এই কথাটা আর ভাবতে পারি না যে এসব ঘটনার কথা আর কোনওদিন শুনতে হবে না এরকম এক উন্নত সমাজে আমাদের উত্তরণ ঘটে গেছে! কিন্তু কেন? কেন এরকম হয়? এমনটা তো হবার কথা ছিল না! যারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে বহু আত্মবলিদান, বহু রক্তপাত, বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ নামক এই ভূখণ্ডটাকে বিদেশী দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন, সমাজটাকে সংস্কার করছিলেন, তাঁদের একটা অমলিন স্বপ্ন ছিল যে স্বাধীন দেশের ভোটাধিকার প্রাপ্ত নাগরিকরা খুব সচ্ছল জীবনযাত্রা না হোক অন্ততঃ মোটা ভাতকাপড়, কর্ম, আশ্রয়, স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত হবেন না আর সবথেকে জরুরী যে বিষয়–শিক্ষা তার অন্ততঃ কোনও অভাব হবে না, থাকবে না কোনও প্রতিবন্ধকতা, তা সেই মানুষটা যে শ্রেণীরই হোন না কেন। কিন্তু কোথায় গেল তাঁদের সেই স্বপ্ন? সে কি শুধু ইতিহাসের কল্পকথা? নাকি তামাদি হয়ে যাওয়া একটা শপথ! যারাই একটু সংবেদনশীল তাঁদের মনের আনাচে কানাচে এই প্রশ্নটাই ঘুরেফিরে আসে! কোনও এক স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে জনপ্রিয় একটি বাংলা দৈনিকের ক্রোড়পত্রে একজন বরিষ্ঠ কবির খেদোক্তি আজও স্মরণে আসে। আমরা পড়ে ক্ষণিক স্তব্ধ হই বটে,তারপর যে কে সেই! আমরা উদসীন হয়ে যাই। আমরা ব্যস্ত হই যার যার নিজের কাজ নিয়ে, আয় রোজগার নিয়ে, সংসার প্রতিপালন নিয়ে,সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে। কার আর অত সময় থাকে পরের কথা ভাববার? পরার্থপরতা সমাজ জীবন থেকে উধাও হচ্ছে। স্বার্থপরতাই প্রাধান্য পাচ্ছে। হয়ত আধুনিক সমাজের লক্ষণ সেটাই। কিন্তু প্রশ্ন জাগে মনে, এ কোন আধুনিকতা? আধুনিকতা মানেই কি শুধু আত্মস্বার্থ চরিতার্থতা? আমাদের সমাজ আধুনিক নাকি উত্তর আধুনিক না প্রাক আধুনিক –এই গূঢ় প্রশ্নের মীমাংসা করার জন্য কূট তর্ক-বিতর্কের ইচ্ছা এখানে আমাদের নেই। সে দায়িত্বটা অন্যদের। প্রশ্নটা হল যে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রসারণের ফলে যে আলোকদীপ্তি একটা মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণায় নিমজ্জিত সমাজের উপর আলো ফেলল, সেই আলোকদীপ্তি কোথায় গেল? কোথায় গেল সেই রাজনৈতিক সচেতনতা, যে সচেতনতা মানব মুক্তির কথা বলত? রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দলগুলির গত ৬০ বছর যাবত ভোটের সময় লম্বা লম্বা নির্বাচনী ইস্তাহারের ফিরিস্তি, অগুনতি প্রতিশ্রুতি, শপথ–কোনও কিছুই তো বদলাতে পারল না এই বৃহত্তর মাপের অভাব অভিযোগের! আমাদের এই কথাটা বলার উদ্দেশ্য নয় যে রাষ্ট্রর কোনও সদিচ্ছা নেই বা এই সংকট থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায় তার দিশা খুঁজে বার করার কোনও সদর্থক প্রচেষ্টা নেই। রাষ্ট্রীয় তহবিল বা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে যে আর্থিক অনুদান পাওয়া যায় তার কতটুকু পৌঁছায় ঐসব ক্ষেত্রে? আমাদের প্রত্যহ অভিজ্ঞতাটা অন্যরকম এ ব্যাপারে। কথায় আছে, গ্রামে ১ টাকা পাঠালে মাত্র ২৫ পয়সা যায় বাকী ৭৫ পয়সা কারুর পকেটে ঢোকে। অর্থাৎ দুর্নীতি যা ভারতবর্ষ নামক দেশটাকে ছিবড়ে করে দিচ্ছে। ঘুষ আর টাকা চুরির (কাট মানি) ঠ্যালায় আম জনতার জীবন বিপর্যস্ত! সুতরাং উন্নয়ন অসম। কসমোপলিটান শহর গুলোর বাড়বাড়ন্ত,  ফ্লাই ওভার, শপিংমল হাই-রাইজের ব্যাপক বিস্তার অথচ প্রান্তবর্তী সীমানায় যারা রয়েছেন তাঁরা সর্বাধিক বঞ্চিত, তাঁদের জীবনের কোনও পরিবর্তন নেই–পাণীয় জল, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, শিক্ষাকেন্দ্র সুদ্ধু সামগ্রিক প্রয়োজনীয় ও যথাযথ পরিকাঠামোর ভয়ঙ্কর অভাব। বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। শহর ও গ্রামের মধ্যে ফারাক বেড়েই চলেছে। “দেহের সমস্ত রক্ত মুখে এসে জমছে।”

এই রক্ত জমাটবাঁধাটা কি ভাল লক্ষণ? সার্বিক উন্নয়নের কথা যারা ভাবেন তাঁদের কাছে এই লক্ষণ মোটেই সদর্থক নয়। এতে তো শুধুমাত্র দেশ বা সমাজের মূল কেন্দ্রগুলিতে বসবাসকারী মানুষজন বা আর একটু মননিবেশ করে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে যে মূলতঃ শহরবাসীরাই এই “দেহের সমস্ত রক্ত মুখে এসে জমছে ..”-র সর্বাধিক সুবিধা ভোগী। সেখানে ভোগের নানা আয়োজন। আমোদে ফুর্তিতে উড়ে যাচ্ছে লাখ লাখ টাকা; শুধুমাত্র শারদ উৎসবেই কোটি কোটি টাকার বন্যা বয়ে চলে যখন সত্যিকারের বন্যায় গ্রামবাংলা ভাসে ফি বছর! শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য-থিয়েটার-সিনেমায় বয়ে চলা প্রগতিশীলতার বন্যায় ভাসমান আমুদে বাঙালী, হয় কথায় নয় কথায় মিছিল মিটিং-এ জেরবার, সোচ্চার “কল্লোলিনী” কলকাতার “তিলোত্তমা” হয়ে ওঠার কাব্যিক তকমা (যা হয়তো মহতী কবির জীবন সম্পৃক্ত ভাবনায় অন্যরকম ছিল!) বা গা চিড়বিড় করানো “ডেড সিটি” উপাধি প্রাপ্তির আড়ালে কেমন করে যেন হারিয়ে যায় প্রান্তিক মানুষদের দুর্গতির কথা! একজন মেধাবী ছাত্র জে.ই-র মতন কঠিন পরীক্ষায় চমকপ্রদ সাফল্য দেখিয়ে শহরের সর্বোচ্চ মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েও ফিরে যায় শুধুমাত্র টাকার অভাবে! কারণ সে মধ্যসত্বভোগী নয়, প্রিভিলেজড ক্লাসের প্রিভিলেজের ল্যাজটা যে তার হাতের মুঠোয় নেই! কারণ সে যে নিম্নবর্গীয়! ভাবতে অবাক লাগে কবে আসবে আমাদের লজ্জাবোধ!!? আমরা ক্রিকেট-কার্গিলে ভীষণরকম জাতীয়তাবাদী; চেতনায় পোস্টমর্ডান হলেও একটু আধটু রেসিস্ট, না হলে আর সিন্ধুপারের হিন্দু হলাম কি করতে? সোনার চাঁদ সোনার টুকরো বলে তো ওদেরকে খানিকটা ঠেকিয়ে রাখা গেছে!! পোস্ট মডার্নের পোস্ট বেয়ে ছেয়ে যে তরতর করে উপরে উঠতে হবে, না হলে আর কি হল!!? সবই যে বৃথা! নাঃ!.. নেই! আমাদের কোনও লজ্জাবোধ নেই!!

উন্নয়ন শব্দটা এখন একটা খুব জনপ্রিয় মুখরোচক, আমরা চাই বা না চাই এটা ঘাড়ের উপর চলে আসবেই। শব্দটার মধ্যে অনেককিছু জড়িয়ে যায়। কৃষকের জমির দখল নেওয়া থেকে মধ্যবিত্তের ঝাঁ চকচকে বিদেশী স্টাইলের নাগরিক জীবন যাপনের স্বপ্ন,  শিল্পপতিদের কলকারখানা থেকে নগরায়ন, উন্নত পরিকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থা–এ সব ঢুকে পড়েছে এই শব্দটার মধ্যে। আজকের দিনের স্বপ্নের নিরিখে “উন্নয়ন” নামক এই ভয়ানক মহার্ঘ শব্দটার মাহাত্ম্য অনেক। শ্রেণীগত বিভেদের আড়ালে এর এক এক রকম অর্থ। যা এক শ্রেণীর মানুষের পক্ষে ভালো তো আর এক শ্রেণীর মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর। তার উপর চাওয়া পাওয়া গুলোর মধ্যে নেই কোনও সামঞ্জস্য। অর্থাৎ সকল শ্রেণীর মানুষের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে এমন কোনও পরিকল্পনা কখনোই গড়ে ওঠে নি।  না হলে কি আমরা বলতে পারতাম যে শিল্পায়নের ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠা উপনগরীতে চাকর বাকর কিম্বা ধোপা নাপিতের কাজ করবে পিতৃপুরুষের অর্জিত-জমি হারানো চাষী পরিবার, উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাবে যাঁদের কোনোভাবেই স্থান হওয়া সম্ভব নয় ঐ ইন্ডাস্ট্রিতে। আমরা চেয়েছিলাম ঐতিহ্যগত পেশা থেকে তাঁদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে! অথচ পাঁচহাজার বছর ধরে পরিচালিত কৃষিব্যবস্থা থেকে বংশানুক্রমিক ভাবে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও তাঁদের কৃষি-জ্ঞান থাকবে উপেক্ষিত, না হবে তা নিয়ে কোনও আলোচনা, না হবে কোনও গবেষণা, না গড়ে উঠবে কোনও পূর্ণাঙ্গ তথ্যভান্ডার যা ঘটাতে পারত পড়ন্ত কৃষি-শিল্পের নতুন উজ্জীবন।  তা না করে আমরা শিল্পায়ন শিল্পায়ন করে উদ্বাহু নেত্য শুরু করলাম আমাদের সৌখিন স্বপ্ন চার চাকার একটি যান্ত্রিক গুবরে পোকা বা আরও অনেক কিছুর জন্য! তার পরের সব কুৎসিত ঘটনাবলী, যা ফ্যাসিস্টদেরকেও নিঃসন্দেহে অনুপ্রাণিত করবে–সে সব আজ ইতিহাস। নিতান্ত হাটুরে মানুষ থেকে সুশীল সমাজ ঘুরে দাঁড়িয়ে যখন পাল্টা প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন তখন প্রগতিবাদীতার মিথ্যে ধ্বজাধারী-গণশত্রুদের উদ্ধত ল্যাজ নেতিয়ে দু’পায়ের ফাঁকে ঢুকে গেল। সে সময় আমরা নির্ভীক সাংবাদিকতা করেছি, ওবি ভ্যান নিয়ে ইতিহাসের দলিল তৈরী করেছি, শিল্পায়ন নিয়ে প্রচুর কূটকচালী করেছি! কিন্তু যেটা হারিয়েছি সেটা হল বিশ্বাস। দীর্ঘ বঞ্চনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বিশ্বাস যা হয়তো কক্ষনও আর ফিরে পাওয়া যাবে না! এ সবই প্রতিবাদী মানুষ ও পরিবেশবিদদের দেওয়া তথ্য যে তথ্য বলছে ভারতে উন্নয়ন-উদ্বাস্তুর সংখ্যা প্রায় আধকোটি যারা তথাকথিত উন্নয়নের বলি–উৎখাত হয়েছেন নিজের ভিটেমাটি থেকে। কোথায় যে তাঁরা হারিয়ে গেছেন কেউ জানে না! এই বৈষম্য তৈরী করেছে বিভেদের বিশাল প্রাচীর। বিক্ষুব্ধ প্রান্তিক মানুষ গুমরে গুমরে শেষ হয়ে গেছেন নয় তো এই দেশটাকে নিজের দেশ বলে আর ভাবতে পারছেন না। খুবই ভয়ংকর একটা ভাবনা। ভাবলে শিউরে উঠতে হয় যে এর ভবিষ্যৎ কোথায়! জোর জবরদস্তি করে কি কোনও ন্যাশানাল আইডেন্টিটি গড়ে তোলা যায়? বোধহয় যায় না। সকলের ভাল হবে এমন পরিকল্পনা কোথায়? এর উপর সমাজের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত শ্রেণীর মানুষদের বিরাট এক অংশের ব্যাপক, মাত্রাহীন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া!–যাঁদের কোনও চেদবেদ নেই, তাঁরা কি করছেন কেন করছেন সেটা নিয়েও নেই কোনও অনুশোচনা। বরঞ্চ পরোক্ষভাবে এর প্রতি ভেতরে ভেতরে একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে তাঁদের! সবটাই ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠিগত স্বার্থ, ভাবনার ফসল।

দেশের প্রতিটি মানুষের সাথে যে গভীর সংযোগ-সংলাপ থাকা দরকার সে কথা তো নতুন কোনও কথা নয়– আধুনিকতার প্রবক্তা, আমাদের বরণীয় মনীষীরা তা বারে বারে বলেও গিয়েছিলেন আর তার জন্যই তো তাঁরা শিক্ষার উপর এতো জোর দিয়েছিলেন; নিজেরাও সচেষ্ট ছিলেন কি ভাবে শিক্ষার আবহ গড়ে তোলা যায়, প্রসারণ ঘটানো যায় সমাজের সর্বস্তরে, হোক না সে পরাধীন দেশ, তবুও! এটা ভাবতে খুবই অবাক লাগে যে ঐ রকম একটা সময়ে কি ভাবে বিজ্ঞান চর্চা, গবেষণা, শিক্ষাদীক্ষায় প্রাবল্য এসেছিল তা আজও এই স্বাধীন দেশে বসে আমরা ভাবতে পারি না! অথচ আজ তা বুদবুদের মতো মিলিয়ে গেছে কোথায় যেন! আমরা হারিয়েছি সেই গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলো! তখন স্কুলকলেজ স্থাপন করা হত সমাজের সার্বিক মঙ্গলের জন্য আর এখন হয় ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। আর সেখানে ভিড় করতে পারেন সমাজের অর্থবান মানুষরা। যাঁদের সেই আর্থিক ক্ষমতা নেই, অগুনতি হতদরিদ্র নিম্নবর্গীয় মানুষ, তাঁরা ব্রাত্য সেখানে। সরকারী অনুদানে চলা স্কুলকলেজ আর কটা যে বিপুল সংখ্যক মানুষের চাহিদা মেটান যায়? পড়াশোনার মানও যে সব জায়গায় সমান তা নয়। অভাব অভিযোগ বিস্তর। গোদের উপর বিষফোঁড়া সস্তা দলীয় রাজনীতির মাতব্বরি, সূক্ষ্ম রেসিসিজম বা ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক মনোভাব সব মিলিয়ে শিক্ষার সার্বজনীন প্রয়োগ দূরঅস্ত! এভাবেই শিক্ষার আলোক-স্পর্শ অধরা থেকে যায় রামা কৈবর্ত, হাশেম শেখ, রামু বড়ালদের জীবনে।

এখানে একটা সত্যি ঘটনার কথা জানিয়ে রাখি। না জানালে অপরাধ হবে। বেশ কয়েকবছর আগে, ৯০-র দশকের শেষদিকে আমরা কয়েকজন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শংকরপুর বেড়াতে গিয়েছিলাম। বিকালবেলা ফিসারিজ ডিপার্টমেন্টের অধীনে যে বিশাল সমুদ্র সৈকত সেখানে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছি, সমুদ্রের বিশালত্ব, সৌন্দর্য ইত্যাদি উপভোগ করছি। ছোটরা বীচে বালি নিয়ে খেলা করছে। এমন সময় অনেকদূর থেকে, কালো কালো বিন্দুর মত লাগছে, একদল জেলে মাছ ধরার জাল ও অন্যান্য সাজ সরঞ্জাম নিয়ে হেঁটে আসছে। সঙ্গের মেয়েরা দেখতে পেয়ে ঠিক করলো ওদের কাছ থেকে মাছ কিনবে। কিছুক্ষণ পর কাছে আসতেই যথারীতি মেয়েরা সব ঝাঁপিয়ে পড়লো মাছ দেখার জন্য। জেলেদের কাছে তেমন কিছু ছিল না; হেসে বলল, দিদি আজ তেমন মাছ ওঠে নি জালে, সারাদিন খেটে তেমন কিছু পাই নাই। ওদের একজনের কাছেই শুধু কেজি দু’য়েক সামুদ্রিক চুনো মাছ ছিল। তাই বার করে দেখাতে লাগল। মেয়েরা সানন্দে তাই ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে কিনতে চাইল। যে জেলের মাছ সেই যুবক জেলে হাসতে হাসতে সামান্য দরাদরি করে মাত্র শ’দেড়েক টাকায় ঐ কেজি দু’এক চুনো মাছ নির্বিবাদে দিয়ে দিল এবং বলেও দিল কিভাবে ধোয়াধুয়ি করে ভাজতে হবে। এরপর জেলেরা সব গুছিয়ে গাছিয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল, আমি ওদের একটু পেছনেই হাঁটছিলাম। বাকিরা সবাই কিছুটা পিছনে হেঁটে আসছে। জেলেরা কথা বলতে বলতে হাঁটছিল, মাছ বিক্রি করলো যে ছেলেটা, ওদের মধ্যে একজন তাকে বলল– মাছগুলো দিয়ে দিলি.. এতো সস্তায়? ছেলেটা পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে একটুখানি চুপ করে থেকে স্বগতোক্তির মতো বলে উঠলো–হ্যাঁ.. দিলাম। দেশের মানুষকেই তো দিলাম। কোনও বিদেশীকে তো দিই নাই! কথাটা আমাদের সঙ্গের কেউ শুনতে পায় নি, এক আমি ছাড়া। শুনে আমি যেন একটা ইলেকট্রিক শক খেলাম! বোধবুদ্ধিতে কে যেন সপাং করে একটা চাবুক মারল! সত্যি তো! এভাবে তো আমরা কখনও ভাবি না! আমি কেমন যেন ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে গেলাম। মনটা দমে গেছে। হোটেলে ফিরে কাউকে কিছু বলতেও পারলাম না। শুধু মাথার মধ্যে কথাটা ঘুর ঘুর করতে লাগল। পরে এটা নিয়ে অনেক ভেবে দেখেছি। শুধু মনে হয়েছে, দেশের এই সহজ সরল হতদরিদ্র নিম্নবর্গীয় মানুষগুলোকে সত্যিই আমরা চিনি না! যাদেরকে আমরা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করি, হেয় জ্ঞান করি, দয়া দাক্ষিণ্য করি, নিজেদেরকে ওদের উদ্ধারকর্তা ভাবি, সেই শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত মানুষ আমরা, শহুরে বাবুলোকরা বোধহয় কোনোদিনই ওদের বোধের সীমানায় পৌঁছতে পারব না! ঘটনাটা হয়তো একটা তুচ্ছ ঘটনা। প্রতিদিনই এরকম অনেক ঘটনা ঘটছে। আমরা কেয়ার করি না। কিন্তু কেয়ার না করলেও এর পেছনে যে একটা গভীর দেশপ্রীতি, দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা, সম্মান আছে, বিশেষ করে মেয়েদের প্রতি যে একটা বিশেষ শ্রদ্ধা আছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমি একশ ভাগ বিশ্বাস করি এখন। কারণ এই রকম আরও অনেক নজির আছে আমার কাছে। কিন্তু প্রতিদানে আমরা কি দিই? কিছুই না। শুধু বিশ্বাসঘাতকতা!! তা নিয়ে মনেহয় নতুন করে কিছু বলার নেই। ভাবলে অবাক হতে হয়, লজ্জাবোধ হয়!

এখন এখানে একটা কথা তুললে ভীষণ বিতর্ক বেধে যাবে। সেটা হল ভারত আর ইন্ডিয়া-দুটো দেশের কথা যা অনেকেই মানতে চাইবেন না। কিন্তু তাতে তো সত্যটা পালটে যাবে না বা মিথ্যে হয়ে যাবে না। হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও সত্যটা সত্য-র জায়গাতেই থেকে যাবে। সেটাই বাস্তব। সেই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার মতন মন আছে কার? কোন শ্রেণীর মানুষের আছে? যাঁদের থাকার কথা তাঁরা তো অন্য স্বপ্নে বিভোর! সে স্বপ্নের নাম গ্লোবালাইজেশান! খুব গালভরা নাম একটা! ভাবলে মনে হয়,কি না কি একটা বিপ্লব ঘটে গেছে সারা বিশ্বে! সারা পৃথিবী এক হয়ে গেছে। এ এক মস্ত ভুবনগ্রাম। এইসব হাবিজাবি অজস্র আবর্জনা সুলভ কথাবার্তা আমাদের প্রতিনিয়ত গেলানো হচ্ছে যা হজম তো হচ্ছেই না উলটে বদ হজমের চোঁয়াঢেঁকুর ও তার বিশ্রী পচা দুর্গন্ধে সামগ্রিক চিন্তার জগত, তার পরিবেশ বিষাক্ত হচ্ছে। আসলে যে কি ঘটছে সেটা জানবার বা শোনবার মতন মন আছে কার? উন্নয়নের গুঁতোয় সবাই এখন সামনের দিকে পড়িমরি করে ছুটছেন কি করে গ্লোবাল-মেল নামের ট্রেনটাতে দ্রুত উঠে পড়া যায়, না হলে যে ইহজীবনের ভোগবাদটাই হয়ত ফসকে যাবে! মনের মণিকোঠায় তাঁদের কারেন্সি হল ডলার, রাজধানীগুলো হল লন্ডন-ওয়াশিংটন-টরেন্টো-মস্কো-বেজিং-টোকিও, ইউনিক গ্লোবাল পোশাক, ইউনিক গ্লোবাল খাদ্য এমনকি ইউনিক একটা কালচারের প্রতি তীব্র আকর্ষণ–এক কথায় নিজভূমে পরবাসী কিন্তু মনে মনে বিশ্বনাগরিক “ঘেঁটে ঘ” হওয়া আর সেই সঙ্গে মেধা, প্রতিভার বিসর্জন, ব্রেন ড্রেন! এই হল পোশাকি বিশ্ব নাগরিকত্ব-র চেহারা! এঁরা হচ্ছেন ইন্ডিয়ার আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক লোক নাকি নাগরিক জঙ্গল, কে জানে? এঁরা পণ্য-মৈথুন মৌতাতে মেতে আছেন, বিরাট সংখ্যক প্রায় ২৫ কোটির কনজিউমার ক্লাস যাঁদের দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দেশি-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। ইন্ডিয়ার এই নাগরিকরা জলের বোতল আর সেল ফোন হাতে শপিংমলে চরে বেড়ায় আর তখন ভারতের লোক ফুটো হাঁড়ি নিয়ে নদীর চরে জল খুঁজে বেড়ায়। রাষ্ট্রের উচ্চপদাধিকারী আমলা ফ্রান্সের জনসাধারণকে অনুরোধ করে বলে আসেন–আপনারা বলিউড দেখে ভারতকে চিনবেন না। এর চাইতে নির্মম সত্য আর কি হতে পারে? এইখানেই ভাগাভাগিটা হয়ে যাচ্ছে–একটা দেশের মধ্যে আর একটা দেশ। পাঁচহাজার বছরের পুরনো একটা দেশের যে সামাজিক বিধি ব্যবস্থা ছিল তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল ঔপনিবেশিক কারণে অথচ গড়ে ওঠেনি উপযুক্ত নতুন কোনও আধুনিক ব্যবস্থা–রাস্তা নেই, আলো নেই, পাণীয় জল নেই, স্কুল নেই, কলেজ নেই, নেই হাসপাতাল–যেটুকু আছে তারও টিমটিমে করুণ অবস্থা। অনুদান যা আসে তাও বারো ভূতে লুটেপুটে খায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার তার মধ্যে টুনি বাল্বের মতন আলো ঠিকরচ্ছে কসমোপলিটান শহরগুলো যেখানে পাশাপাশি ভোগ আর উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে চলছে। স্বভাবতই একটা বৈষম্য প্রকট, প্রান্তিক অঞ্চল আর একটা কসমোপলিটান শহরের মধ্যে ব্যবস্থার আসমান জমিন ফারাক।

এ রকম অবস্থায় মধুসূদনরা কি করবে? শিক্ষার সার্বজনীন অধিকারের দাবীতে শহরের বাবু-শ্রেণীর দ্বারা পরিচালিত কোনও রাজনৈতিক / অরাজনৈতিক সংগঠনের ছত্রছায়ায় যাবে নাকি কোনোক্রমে শহরের এক কোনায় মাথা গুঁজে প্রাণপণ যুদ্ধ চালাবে তার শিক্ষাটা সম্পূর্ণ করার জন্য? যারা বোঝে তারা ২য় পথটাই বেছে নেয়, তাদের কাছে শিক্ষাটাই বড় অস্ত্র, অন্য কিছু নয়! তারা জানে অন্য যে কোনও অস্ত্রের থেকে এই অস্ত্র অনেকবেশী শক্তিশালী। যেখানে সমস্ত আশা ক্ষীণ হয়ে যায়, প্রশ্ন ওঠে কে দেবে আলো, কে দেবে আশা, কে যোগাবে ভরসা সেখানে মধুসূদনদের এই লড়াই বৃহত্তর প্রেরণা যোগায় আর এক কোনও মেধাবী সতীর্থকে। হয়তো ওরাই হবে ভারতবর্ষ নামক দেশটার ভবিষ্যৎ যারা হয়ে উঠবে স্ব-ভূমির প্রকৃত উন্নয়নের দিশারী, যারা তাদের প্রান্তিক-উন্নয়ন দিয়ে ভোগবাদী ইন্ডিয়াকে ঘিরে ফেলবে, সেদিন বোঝা যাবে মুখ আর মুখোশের পার্থক্য, উন্মুক্ত হবে আমাদের প্রকৃত চরিত্র; সেদিনই শুরু হবে আমাদের স্বাধীনতা যোদ্ধাদের অমলিন স্বপ্ন সফল হওয়া, বিদ্যাসাগরের অসমাপ্ত আরাধ্য কাজের জয়যাত্রা!!

–আম পাবলিক ব্লগারু

Posted in আলোচনা, প্রবন্ধ, সংবাদ, সমাজ | Tagged , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , | মন্তব্য দিন